চতুর্থ অধ্যায়
দিল্লি সুলতানি তুর্কো আফগান শাসন
মহম্মদ ঘুরি কে ছিলেন ?
মুইজউদ্দিন ১১৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান আফগানিস্তানের ঘুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের প্রকৃত তারিখ অজ্ঞাত। তার বাবা প্রথম বাহাউদ্দিন সাম ছিলেন ঘুরের একজন স্থানীয় শাসক। মুইজউদ্দিনের বড় ভাই ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মুহাম্মাদ। জীবনের প্রথমদিকে তাদের চাচা আলাউদ্দিন হুসাইন তাদের দুজনকে বন্দী করেন। কিন্তু পরে তার ছেলে সাইফউদ্দিন মুহাম্মাদ তাদের মুক্তি দেন। ১১৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সাইফ মারা যাওয়ার পর ঘুরি অভিজাত ব্যক্তিরা গিয়াসউদ্দিনকে সমর্থন দেন এবং তার ক্ষমতালাভে সহায়তা করেন। গিয়াসউদ্দিন এরপর মুইজউদ্দিনকে ইসতিয়ান ও কাজুরানের শাসনভার দিয়েছিলেন। বেশ কয়েকজন ঘুরি নেতৃবৃন্দ সিংহাসনের দাবি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়লে তাদের পরাজিত করার জন্য মুইজউদ্দিন তার ভাই গিয়াসউদ্দিনকে সহায়তা করেন।
দিল্লির সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
সুলতান কে?
উ: মহম্মদ ঘুরি মারা যান ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে। তারউদ্দিন ইয়ালদুজ, নাসিরউদ্দিন কুবাচা, বখতিয়ার খলজি এবং কুতুবউদ্দিন আইবক এই চারজন ছিলেন মহম্মদ ঘুরির অনুচর। তার মৃত্যুর পর মহম্মদ ঘুরির জাবরা অঞ্চলগুলি ভাগ হয়ে যায় তাঁর এই চার অনুচরদের মধ্যে। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন কুবাচা সুলতান ও উচ্চ শাসনকর্তা হলেন। কুতুবউদ্দিন আইবক হন লাহোর ও দিল্লির শাসনকর্তা, তারউদ্দিন ইয়ালদুজ হন গজনির অধিকারী এবং বাংলাদেশের শাসনকর্তা হয়ে বসেন বখতিয়ার খলজি।
সুলতান একটি আরবি ভাষা যার মানে কর্তৃত্ব, ক্ষমতা বা দক্ষতা। ভাবার 'সুলতান' এই কথাটা ব্যবহার করা হতো উপাধি হিসেবে। যেমন তুর্কির শাসনকর্তারা এই সুলতান শব্দটিকে উপাধি হিসেবে ব্যবহার করতেন। সুলতানেরা নিজেদের অঞ্চলের মধ্যে রাজত্ব বা শাসন চালাতেন, তাকে বলা হতো সুলতানৎ বা সুলতানি রাজধানি দিল্লিকে কেন্দ্র করে আইবক সুলতানি শাসন করতে শুরু করেন। দিল্লি সুলতানি বা সুলতানৎ বলার কারণ সুলতানেরা দিল্লিকেই প্রধান কেন্দ্র করে নিজেদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বজায় রেখেছিলো।
খলিফা ও সুলতানের সম্পর্ক :
উঃ খলিফা হল একজন শাসক। ইসলাম ধর্ম অনুসারে প্রধান শসক একজনই আর তিনি হলেন- খলিফা। দিল্লির সুলতানিদের ধর্মগুরু ছিলেন এই খলিফা। ইসলামের অধীনে যত অঞ্চল বা রাজ্য ছিলো, তার প্রধান শাসক হলেন খলিফা। তিনি ধর্মগুরু থাকার ফলে দিল্লির সুলতানির উপরেও অধিকার ছিলো।
ভারতবর্ষে মুসলমানদের শাসন ছিলো খুব বিশাল অঞ্চল জুড়ে। এই বিশাল অঞ্চলকে কর্তৃত্ব দেওয়া মাত্র একজন খলিফার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এই অসম্ভব ক্রিয়াকে সম্ভব করার জন্য ব্যক্তিরা নানান অঞ্চল থেকে এসে খলিফার থেকে অনুমোদন নিয়ে নানান অঞ্চলে শাসন করতো।
যেমন—ইসলামের আওতায় যত অঞ্চল ছিলো তার প্রধান শাসক ছিলেন খলিফা। তেমনই হিন্দুস্তান বা ভারতবর্ষের প্রধান শাসনকর্তা ছিলেন সুলতান। সুলতানরা খলিফাদের মেনে চলতো ঠিকই তবে যে খুব বেশি মেনে চলতো তা নয়। খলিফানের একটা বিশেষ কর্তৃত্ব ছিল। যেমন উদাহরণ হিসেবে যদি ধরা হয় কোনো এক তুর্কি সেনাপতি অনেক অঞ্চলে জয় করেছেন। তিনি চান ওই অঞ্চলটি নিজেই শাসন বা কর্তৃত্ব চালাতে, সেই সেনাপতি নিজের শাসন চালানোর আর্জি জানিয়ে খলিফাকে নানান উপহার পাঠান যাতে সে তাকে সুলতানের স্বীকৃতি দিয়ে তাকে শাসক হিসেবে ঘোষণা করে। এতে বোঝা যায় যে সেই সময় খলিফাদের অনুমোদনের বা সিদ্ধান্তের অত্যন্ত সম্মান ছিলো। সুলতান হওয়া নিয়ে যখন গোলমাল বেঁধে যেতো তখন এই খলিফাদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। খলিফার আদেশ বা সিদ্ধান্তকে নাকচ করতে পারত না। এই সুলতান হওয়া নিয়ে গোলমাল শুরু হল দিল্লির সুলতানিতেও। তাজউদ্দিন ইয়াগদুজ ছিলেন গজনির শাসক। তিনি দিল্লির ওপরে নিজের অধিকার কায়েম করতে চাইলেন। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তে কুতুবউদ্দিন রাজি হলেন না। তাজউদ্দিনের গজনির শাসক হওয়াকে মেনে না নিতে সে গজনির সঙ্গে দিল্লির সমস্ত সম্পর্ক বন্ধ করে দিলেন।
কিন্তু, ইলতুৎমিস 'মানে কুতুবউদ্দিনের জামাই যখন সুলতান হলেন তখন সেই গোলমাল আবার জটিল হয়ে উঠল। এই জটিলতার কারণ হল ইলতুৎমিস কুতুবউদ্দিনের ছেলে নয়, জামাই। তার উপরে নাসিরউদ্দিন কুবাচা মুলতান থেকে এসে লাহোর ও পাঞ্চাবের বেশ খানিকটা অঞ্চল দখল করেন। সে দখল করা অঞ্চল ছাড়াও আরও অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষমতাবান তুর্কিবা শাসন করতে লাগলেন। এর ফলে ইলতুৎমিস বিপদে পড়েন। আমির ক্ষমতায় আসাতে নানান গুলিতে যখন কর্তৃত্ব করতে লাগলো তখন ইনতুৎমিসকে কেউ আর দিল্লির সুলতান হিসেবে মানতে চাইলো না। তারা তার অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
ইলতুৎমিসের সুলতান হওয়াকে না মেনে যখন তার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় তখন ইলতুৎমিস নিজের অধিকার শাসন বজায় রাখতে খলিফার কাছে নিজের অনুমোদনের আর্জি বা প্রার্থনা করেন। তিনি খলিফার কাছে নানা উপহার পাঠান যাতে তার পার্থক্য খলিফা মেনে নিয়ে তার ইচ্ছা পুরণ করে। সেই উপহার পাওয়ার পরে তার বদলে বাগদাদের খলিফা ইলতুৎমিসকে দূরবাস ও বিলতি পাঠান যে দিল্লির সুলতানিতে ইলতুৎমিসের কর্তৃত্ব থাকবে।
খালিফার অনুমোদন:
হুলিফার অনুমোদন পেয়ে ইলতুৎমিস যখন দিল্লির সুলতানিকে বজায় রাখলো তখন এই একইভাবে যখনই শাসক ও অধিকারের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠত, ঠিক তখনই দিল্লির সুলতানরা খলিফার আনুগত্য স্বীকার করে তার অনুমোদন চাইতেন, কারণ খলিফার একটা সম্মান ছিলো তার আদেশ বা কথাকে কেউ অমান্য করতো না। এইভাবে দিল্লির সুলতানেরা খলিফাদের সাহায্য নিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলো। কিন্তু দিল্লির সুলতানেরা যে শুধু নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলো তা নয়। তারা কাজের দিক থেকে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।খলিফারা কখনো দূর ভারতবর্ষে বা হিন্দুস্তানের কোনো ব্যাপারে নিজেরা হস্তক্ষেপ বা মতামত দিতেন না। সবটাই ছেড়ে দিতেন সুলতানিদের হাতে। তার জন্য এভাবেই খলিফাদের হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজেদের মনের মতো কর্তৃত্ব করেছিলো ভারতবর্ষে। দিল্লি সুলতানি হিন্দুস্তান বা ভারতবর্ষে নিজেদের শাসন বজায় রেখেছিলো প্রায় তিনশো কুড়ি বছর।
টীকা লেখ ঃ
শাসকের উপাধি :
শাসকের উপাধি বলতে আমরা জানি রাজা, সুলতান, সম্রাট এই সকল শব্দগুলি। এই উপাধিগুলি বদলে যেতো যখন শাসকের ধর্ম ও দেশ এবং শাসনের ক্ষমতার হেরফের হতো। যেমন রাজা শব্দটি সংস্কৃত শব্দ থেকে এসেছে। রাজা শব্দটির মানে হল যে রাস্তাকে শাসন করে বা রাজা শাসনকর্তাকে রাজা বলা হয়। তার জন্য ভারতবর্ষে অ-মুসলমান শাসকদের রাজা বলা হতো। যেই রাজা অনেক অঞ্চল জয় করে বিরাট অঞ্চলের শাসক হয়েছেন তাকে বলা হতে সম্রাট। সত্রুটি বলা হতো সেই রাজাকে যিনি সাম্রাজ্যের শাসক। তার সেই সাম্রাজ্যের দেখাশোনার দায়িত্ব থাকে সম্রাটের হাতে। রাজা হল সম্রাটের চেয়ে সম্মানের ও ক্ষমতায় ছোটো আর সম্রাট হল রাজার চেয়ে সম্মানে ও ক্ষমতায় বড়ো।
রাজা বা সম্রাটের উপাধি সুলতানেরা নিলেন না কারণ সুলতানরা ছিলেন তুর্কি। কুতুবউদ্দিন আইবক হল তুর্কি জাতি তাই তিনি রাজা নয়। তিনি হলেন সুলতান মানে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবক।
খুতবা:
খুতবা এই কথাটির মূল অর্থ হল ভাষণ অর্থাৎ যখন কোনো সুলতানের কর্তৃত্ব বা শাসনকালে মসজিদের ইমাম একটি ভাষা পড়তেন। শুক্রবার মসজিদে দুপুরে সবার সামনে সেই ভাষণ ইমাম পাঠ করতো।সেই ভাষণে সমকালীন খলিফা ও সুলতানের নাম উল্লেখ করা হতো। এর মধ্যে দিয়ে সবাইকে সুলতান যে নিয়ম মেনে শাসন করছে সেটা তাদের কাছে তুলে ধরতেন।
খলিফার অনুমোদন : ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইলতুৎমিস খলিফার থেকে অনুমোদন পান। নিজেদের খলিফার প্রতিনিধি বলে সুলতানেরা তাঁদের মুদ্রায় খোদাই করতেন। খলিফার নাম প্রতি শুক্রবারে নামাজের সময় উল্লেখ করা হতো। সেই খলিফার নাম মুদ্রায় খোদাই করার প্রথা মহম্মদ বিন তুঘলক প্রথম বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মহম্মদ বিন তুঘলক খলিফার নাম মুদ্রায় খোদাই করার প্রথা চালু করেন। এর জন্য সুলতান ইলতুৎমিস খলিফার থেকে অনুমোদন পত্রও আনিয়ে নিয়েছিলেন। ফিরোজ শাহ তুঘলকও খলিফার অনুমোদন পান দু বার। তারপর থেকে অবশ্য ভারতে খলিফার থেকে অনুমোদন চাওয়া প্রথাটি বন্ধ হয়ে যায়। আর মুঘল বাদশাহরা ভারতের বাইবের বাইকে মর্যাদা ও ক্ষমতায় নিজেদের সমান বলে মনে করতেন না।
আমির-বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বলা হতো, উঁচু বংশে জন্ম।
দূরবাশ- স্বাধীন শাসনের প্রতীক দত্ত।
খিলাত- আনুষ্ঠানিক পোষাক।
৪.৩ দিল্লি সুলতানি খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের প্রথম ভাগ:
১২০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন আইবকের সময় স্বাধীনভাবে দিল্লিতে তুর্কির কর্তৃত্ব শুরু হয়। সুলতানরা প্রথম দিকে ইলবারি তুর্কি ছিলেন। তারপর সুলতান ইলতুৎমিসের কর্তৃত্বর সময় দিল্লির সুলতানির সামনে তিনটি প্রধান সমস্যা ছিল। এই তিনটি সমস্যার মধ্যে প্রথম সমস্যা হল কীভাবে তারা নিজেদের সাম্রাজ্যের মধ্যে বিদ্রোহী শক্তিকে লুপ্ত করবেন।
সুলতানির সামনে সেই দ্বিতীয় সমস্যা ছিল সেটি হল কীভাবে তারা মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ মোঙ্গাল শক্তিকে মোকাবিলা করা যাবে?
তৃতীয় সমস্যাটি হল কীভাবে সুলতানিতে একটি রাজবংশ তৈরি করা যাবে?
যাতে ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীরা কোনোপ্রকার গোলমাল বা যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়াই সিংহাসন আরোহণ করতে পারে?
কিন্তু ইলতুৎমিস ভীত না হয়ে ক্রমাগত যুদ্ধের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের দমন করতে থাকেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে মোঙ্গলদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধের সম্ভাবনা আছে, তবে তিনি কৌশল করে মোঙ্গলদের সঙ্গে যুদ্ধের সমস্ত সম্ভাবনা এড়িয়ে যান। এছাড়া তিনি অনেক চেষ্টার দরুন দিল্লিতে একটি নতুন রাজবংশ তৈরি করে যেতে পেরেছিলেন। দিল্লির সমগ্র জনসাধারণের মনে একটি বংশগত শাসনের একটি ধারণা তৈরি করতে পেরেছিলেন। যার ফলস্বরূপ তাঁর মৃত্যুর পরেও শাসকরা ত্রিশ বছর শাসন ব্যবস্থা চালু রাখতে পেরেছিলো।
পরবর্তী সময়ে সুলতান রাজিয়া ছিলেন ইলতুৎমিসের সার্থক উত্তরাধিকারী। তাঁর শাসনকাল ছিল ১২৩৬-৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দিল্লির সুলতানির ইতিহাসে রাজিয়ার শাসনকাল দু-ভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে। প্রথমত,সুলতান ও তুর্কি অভিজাত অর্থাৎ চিহলগাণির সমগ্র সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক আরো জটিল আকার ধারণ করেছিল এবং দ্বিতীয়ত হল—দিল্লির মসনদে এই প্রথমবার কোনো নারী বসেছিলেন এবং তিনিই ছিলেন শেষ।
এই প্রথম কোনো নারী দিল্লির শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। ইলতুৎমিসের এক পুত্র শাসক হয়েছিলেন অল্পদিনের জন্য। তবে অবশেষে রলিয়াই ইলতুৎমিসের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হতে পেরেছিলেন। ইলতুৎমিসের সব সন্তানদের মধ্যে একমাত্র যোগ্যতম ছিলেন রাজিয়া। অভিজাতদের এক অংশ একজন নারী অর্থাৎ রাজিয়ার সিংহাসনে বসা নিয়ে অনেক আপত্তি করেছিলেন। তিনি খুব নিষ্ঠাভাবে দিল্লির শাসন পরিচালনা করতেন। তাই তিনি দিল্লিবাসীর মনের অনেকাংশে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন।
সুলতানি আমলে অমুসলিমদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করা হয়েছিল। উলেমার আপত্তি থাকলেও রাজিয়া তা মুসলিমদের উপর থেকে জিজিয়া কর তুলে নেন। দিল্লির সিংহাসনে রাজিয়া আরোহণকে সমর্থন করেছিলেন সেনাবাহিনী। অভিজাতদের একাংশ এবং দিল্লির সাধারণ লোকের কাছে, অতি সহজেই রাজিয়া এদের মানে জায়গা করে নিতে পেরিছিলেন।
কিছু সময় পর থেকেই রাজিয়ার শাসনের বিরোধীতা শুরু হয়ে যায়। রাজপুত শক্তি তাঁর শাসনের বিরোধীতা করে। আবার কিছু তুর্কি অভিজাতরা মনে করেছিল যে রাজিয়া অ তুর্কি অভিজাতদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তুর্কি অভিজাতরা কখনই রাজিয়ার শসন ব্যবস্থায় সমর্থন প্রকাশ করেনি। তারা প্রথম থেকেই রাজিয়ার বিরোধিতা শুরু করেছিলেন। রাজিয়া তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাদের দমন করার চেষ্টা করতে থাকেন। রাজিয়ার শাসন ব্যবস্থা সুপথে পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও কিছু ত্রুটি তার শাসন ব্যবস্থায় দেখা যায়। তাই মাত্র সাড়ে তিন বছরের বেশি তাঁর শাসন ব্যবস্থা টেকেনি। তবে যাইহোক না কেন তিনি প্রশংসার যোগ্য ছিলেন।
টীকা লেখ
সুলতান রাজিয়া :
রাজিয়ার উপাধি সুলতানা না হয়ে সুলতান হয়েছিলে। যদিও তিনি একজন নারী ছিলেন।আরবি ভাষায় মূলতানা শব্দের অর্থ সুলতানের স্ত্রী। তিনি নারী হয়েও উপাধি পেয়েছিলেন সুলতান। রাজিয়া তাঁর নিজস্ব মুদ্রায় নিজেকে সুলতান বলে দাবী করেছেন। এই যুগের বিশেষ কয়েকজন ঐতিহাসিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মিনহাজ-উস-সিরাজ, তিনি সুলতান রাজিয়াকে “মুলতানা” বলেই উল্লেখ করেছেন। কারণ তিনি নারী হয়েও পুরুষের ন্যায় কাজ করেছিলেন।
৪.৪ সুলতানির বিস্তার ও স্থায়িত্ব দান : গিয়াসউদ্দিন বলবন :
ইলতুৎমিসের ছেলে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকাল শুরু হয়েছিল ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দে। ১২৪০ সালে সুলতান রাজিয়ার মৃত্যুর কয়েক বছর ধরে তুর্কি অভিজাতদের সঙ্গে ইলতুৎমিসের বংশধরদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য ক্রমাগত সংঘর্ষ চলেছিল। শেষ পর্যন্ত নাসিরউদ্দিন তার রাজত্ব চালায়। তবে তাঁর রাজত্বকালে একজন তুর্কি আমির ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে থাকে। তিনি ছিলেন গিয়াসউদ্দিন বলবন। ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজেই সুলতান হন। সম্পূর্ণরূপে ইলতুৎমিসের বংশের অবসান ঘটে। শুরু হয়ে যায় ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। তিনি কয়েক বছর দিল্লির শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেন এবং তাঁর উত্তরাধিকারীরাও যোগ্যতম বলে প্রমাণিত হয় তিনি আরো প্রায় সাড়ে তিন দশক শাসন করেছিলেন। কুতুবউদ্দিন আইবক থেকে শুরু করে বলবন ও তাঁর উত্তরাধিকারী সুলতানরা ছিলেন ইলবার তুর্কি। তারা মামেলুক নামেও পরিচিত ছিলেন। মামেলুক কথার অর্থ হল দাস।
গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজত্বকালে একটি প্রধান সমস্যা হল ভিতরের বিদ্রোহ। বলবন ছিলেন খুব বুদ্ধিমান।তাই তিনি অতি সহজেই সেগুলিকে দমন করতে পেরেছিলেন। বলবন একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার রাজতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নানা ব্যবস্থা বা প্রথা চালু করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “সিজদা” ও “পাইবস” প্রথা। তিনি এই প্রথা চালু করেছিলেন নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশের জন্য। এর মাধ্যমে তিনি এটাই প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে অভিঘাতদের থেকে সুলতানদের ক্ষমতা অনেক বেশি।
বলবনের রাজত্বের সময়টা ছিল ব্রায়োদশ শতক। এই সময় দিল্লির সুলতানিতে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। সুলতানরা নানা কাজে নিজেদের লিপ্ত করেন যেমন—বন কেটে ফেলে এবং শিকারি ও পশুপালকদের তাড়িয়ে দিয়ে ওই এলাকা অর্থাৎ গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী দোয়ার অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক তার্থনীতিকে মজবুত করেছিলেন। তাঁরা নানা মহাকাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। ভক্তিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি বিলি করতে থাকেন। এর ফলে গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলে সুলতানি শাসনের ভিত মজবুত হয়। তৈরি হয় নতুন শহর, নতুন দুর্গ এবং এক নতুন অধ্যায়।
দিল্লির সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
সুলতানি ও উত্তরাধিকার:
দিল্লির সুলতানি শাসন কে প্রতিষ্ঠা করেন
সুলতান বলা হয় সুলতানির প্রধান শাসককে। তবে অনেক সময় একজন সুলতান মারা গেলে তাঁর পরে কে সিংহাসনে আরোহণ করবে তা নিয়ে নানা সমস্যা দেখা দিত। ইলতুৎমিসের মৃত্যু হয়েছিল ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন খলজি সিংহাসনে বসেন এবং তিনি রাজত্ব চালায় ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ ইলতুৎমিসের মৃত্যুর ঘাট বছর পর্যন্ত। এই ষাট বছরের মধ্যে আনেক নতুন সুলতান অর্থাৎ দশজন সুলতান দিল্লিতে শাসন করেছিলেন। এবং উত্তরাধিকারদের কোনো সাধারণ নিয়ম ছিল না। যার ফলে ঘন ঘন শাসক বদল হয়েছে এবং শাসনের ভিত নড়বড়ে হয়ে থেকেছে। বর্তমান নিয়ম পরিবর্তন হয়েছে। সুলতানদের সন্তান বা বংশবর পরবর্তী সুলতান হবে কিনা তাঁর কোনো নির্দিষ্টতা ছিল না। এই ত্রয়োদশ শতকে নানা ঘটনা ঘটতো যেমন অভিজ্ঞতরা তাদের চতুরতার দরুণ এবং শক্তির বলে যুদ্ধ করে সুলতানের বংশধরদের সরিয়ে নিজেই শাসক হয়ে বসেছে। এই ঘটনা দিল্লির সুলতানিক কয়েকবার ঘটেছে।
দাক্ষিণাত্যে সুলতানির বিস্তার :
আলাউদ্দিন খলজি এরপরে সুলতানরা দাক্ষিণাত্যে তাদের ক্ষমতা বিস্তারের জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। তুর্কি সুলতানদের আমলে তাদের শাসনের ভিত পাকা হয়ে উঠেছিল উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় অববাহিকায়। সুলতানি শাসকরা নানা ভাবে তাদের ভিত মজবুত করতে চেয়েছিলেন। আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন দিল্লির প্রথম সুলতান। তিনি নানা ভাবে ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটাতে থাকেন। তাঁর প্রধান সেনাপতি ছিলেন মলিক কাকুর। তিনি তাঁর অভিমানে নেতৃত্ব দান করেছিলেন।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ :
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবরের সঙ্গে ইব্রাহিম লোদির প্রথম পানিপথের যুদ্ধ হয়। 'বুমি' নামে একটি কৌশল ব্যবহার করা হয় এই পানিপথের যুদ্ধের সময়। এই যুদ্ধ কৌশলটি বাবর তুর্কিকের থেকে শিখেছিলেন। মুঘলদের গুরুত্বপূর্ণ সৈন্য ছিলেন ঘোড়সওয়ার তিরুপজ বাহিনী মানে সৈন্যরা যুদ্ধের সময় গোড়ার পিঠে চড়ে তীর ছুড়তে পারে। তাছাড়াও মুঘলদের আরো ছিলো গোলন্দাজ বাহিনীও। লোদিনের তুলনায় বাবরের সৈন্য সংখ্যা কম ছিল। সংখ্যা কম ছিল কিন্তু তাতে বাবরদের কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি কারণ বাবা ছিলেন যুদ্ধে পটু। সে তার কম সৈন্য নিয়ে মুঘলদের ঘোড়সওয়ার তিরন্দাজ বাহিনী এবং গোলন্দাজ বাহিনীকে পানিপথের যুদ্ধে পরাজয় করেন। এই যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির মৃত্যু হয় যুদ্ধক্ষেত্রেই। তার মৃত্যুর পর দিল্লি ও আগায় মুঘলদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
সুলতানদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সামরিক নিয়ন্ত্রণ অভিযানকারীরা ভারতে বারবার এসেছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে। মোশাল নেতা সেলিম খান খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে (১২১৮-২৭ খ্রিঃ) মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় ঝড়ের গতিতে সে অভিযান করেন। সেই অভিযানের গতির সামনে দুর্বল হয়ে পড়েছিলো ওই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো। এরফলে মোঙ্গল আক্রমণের আশঙ্কা ভারতে তৈরি হলো। এই মোঙ্গল আক্রমণের সময় সুলতান ইলতুৎমিশ ছিলেন নিষ্কির সুলতান। এই আক্রমণের আশঙ্ক পরে চতুর্দশ শতকেও জারি ছিল। দিল্লি সুলতানদের নীতি মোঙ্গল আক্রমণের সামনে সবার এরকম ছিল না
এই মোঙ্গল শক্তির মোকাবিলা মুন্তানেরা করেছিলেন তা এবার দেখা যাক।
বারবার মোঙ্গল আক্রমন ঘটে ভারতের উত্তর-পশ্চিম থেকে। এই আক্রমন হয় ১২২১ খ্রিস্টাব্দে। মোঙ্গল আক্রমণের সামনে সিন্ধু নদ ভারতের পশ্চিম সীমান্ত বলে চিহ্নিত হয়।
মোঙ্গলদের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে না পরে সুতান ইলতুৎমিস দিল্লির সুলতানিকে বাঁচিয়ে দেন।
মোলাল রাজ্যে একাধিক অংশে ভাগ হয়ে যায় চেঙ্গিজ খানের মৃত্যুর পর। তাঁর মৃত্যুর পর তারা ওই সময় ব্যস্ত হয়ে পড়ে পশ্চিম এশিয়া নিয়ে তাঁদের এই পশ্চিম এশিয়া নিয়ে বড় হয়ে পড়া সময়কে দিল্লির সুলতানরা সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শক্তিবুদ্ধি করে নিয়েছিল। এই সুযোগে দিল্লি সুলতানেরা একটা কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রকাঠামো ও স্থায়ী সৈনাবাহিনী তৈরি করার সময় পেয়ে যান। এর ফলে দিল্লির সুলতানদের পরবর্তীকালে মোশাল আক্রমণ ঠেকাতে তাদের খুব সুবিধা হয়েছিল।
পশ্চিম দিক থেকে পাঞ্জাবের লাহোর ও সুলতান শহরদুটো মোজাল অভিযানের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল তখন গিয়াসউদ্দিন বলবন সেই সময় (১২,৪৬-৬৬ খ্রিঃ) মন্ত্রী ছিলেন। দিল্লি সুলতানির পশ্চিম সীমানা পূর্বদিকে আরো সরে আগে মোল্গুল অভিযানের সময়। বিলাম (বিতস্তা) নদীর বদলে আরো পূর্বদিকে বিপাশ নদী নতুন সীমানা হয়েছিল এই মোঙ্গল অভিযানের সময় তাবরহিদ (ভাতিদা) সুনাম ও সম্মানা দুর্গ সুরক্ষিত করে। যখন বলবন সুলতান হন, (১২৬৬-৮৭ খ্রিঃ), বলবন সুলতান হওয়ার পর তিনি নিজে দিল্লিতে শাসন করার জন্য ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকেন। শুধু তাই নয়, লবন কূটনৈতিক চাল হিসাবে মোঙ্গলদের কাছে বুত পাঠিয়েছিলেন। যুবরাজ মহম্মদ ছিলেন বলবনের বড় ছেলে যখন ১২৮৫ মোঙ্গলদের সঙ্গে। ক্লাবনের লড়াই হয় তখন যুবরাজ মহম্মদ সেই পড়াইতে প্রাণ হারায়।
(১২৯৯/১৩০০ খ্রিঃ এবং ১৩০২-০৩ খ্রিঃ) দিল্লি দুবার আক্রান্ত হয় এবং সেই সময় সুলতান ছিলেন আলাউদ্দিন খলজি এক বিরাট সৈন্যবাহিনী তৈরি করেন। আরক্ত তিনি সিরি নামে একটি শহর তৈরি করে তার সৈনিকদের থাকার জন্য। সুলতান আলাউদ্দিন হলজি দেয়ার অন্যলের কৃষকদের উপর বেশি হারে কর চাপান। তিনি সেই কৃষকদের ওপর কর চাপান তার গড়ে তোলা সেনাবাহিনি নিয়ে রসদ জোগানের জন্য, সুলতান আলাউদ্দিন খলজি দূর্গ নির্মণ সৈন্যসংগ্রহ ও মূল্যনিয়ন্ত্রণ করে সফলভাবে মোঙ্গল আক্রমনের মোকাবিলা করেছিলেন।
১৩২৬-২৭/১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মানে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের শাসনকালের সময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মোঙ্গল অভিযান হয়। সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলক মোঙ্গালদের তারা করে তিনি উত্তর পশ্চিম সীমান্তে কালানৌরও পোয়োয়র সীমান্ত ঘাঁটিকে মজবুত করেন। সূলতান এক বিশাল সেনাবাহিনী তৈরী করেন। তার এই সেনাবাহিনী তৈরি করার কারণ হলো তিনি পরিকল্পনা করেন মধ্যে এশিয়া অভিযানের জন্য। সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলক 'পুরোনো দিল্লি’ কে সেনাশিবির বানিয়ে তোলেন তার গড়ে তোলা সৈনিকদের বেতন দেওয়ার জন্য দোয়াব অঞ্চলের ওপর অতিরিক্ত কর চাপান। এতো কিছু করার পরেও মহম্মাদ-বিন-তুঘলকের মধ্যে এশিয়া অভিযানের পরিকল্পনা শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। তার ফলে তাকে তার গড়ে তোলা বিরাট সেনাবাহিনী ভেঙে দিতে বাধ্য হন তিনি।
সুলতানদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা :
প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ সুলতান নিজেই হলেন সুলতানি শাসনের প্রধান ব্যক্তি। সুলতানের হাতেই সব ক্ষমতা থাকত যেমন—যুদ্ধ, বিচার, দেশ চালানোর সব নিয়ম এবং ক্ষমতা, আইন ইত্যাদি এতো কিছু সুলতানের একার পক্ষে সামলানো সহজ ছিল না তাই তিনি মন্ত্রীও তার কর্মচারীদের নিয়োগ করতেন। তার নিয়োগ করা মন্ত্রি ও কর্মচারীদের সুলতানের কাছে অনুগত থাকতে হতো। তাদের কাছে সুলতানের আদেশই ছিল শেষ কথা, তাকে কেউ অসম্মান বা তার আদেশকে অমান্য করার সাহস কারও মধ্যে ছিল না। এইভাবে সেইসময় দিনের পর দিন সুলতানকে কেন্দ্র করে দিল্লিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, একেই বলা হয় কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থা।
সুলতান হওয়া খুব সহজ নয়, এই সুলতান হওয়া নিয়ে কখনও কখনও কে আসল সুলতান তা নিয়ে গোলমাল হতো। এই সুলতান হওয়ার যোগ্য কিনা তার প্রমান দেওয়ার জন্য সেই সময় যে সুলতান থাকত তার সবসময় চেষ্টা থাকতো তার শাগব বা কর্তৃত্ব নিয়ে যেন কেউ কখনো তাকে প্রশ্ন না করে বা তার দিকে আঙ্গুল তোলে।এর জন্য সুলতানেরা সবার থেকে নিজেদের আলাদা রাখতো, সুলতান সব সময় বিচার করতেন খুব কঠোরভাবে,সে কখনো বিচারের সময় গরীব বা ধনীব্যক্তি, অভিজাত বা সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভের রাখতেন না। তার বিচার সবার জন্য একই নিয়মে চলতে যাতে কেউ তাকে প্রশ্ন না করে বার তার বিচারের বিরুদ্ধে কারও কোন অভিযোগ না করে।
সুলতানের শাসন বেশিদিন চলতো যে সুলতান সবদিকে ভালোভাবে সামলতে পারতেন। সব সুলতানদের থেকে বলবনের সময় থেকে সুলতানদের ক্ষমতা ও মর্যাদা বাড়তে থাকে সুলতানের ওপরে বা তার আদেশ অমান্য করার কেউ সাহস পেতো না। তার কোন আদেশের বিরোধিতা করলে শাস্তি পেতে হতো। এরজন্য অভিজাতরা মানে (আমির) আর সুলতানের ক্ষমতা ও মর্যাদা নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন করার সাহস পেতো না, তারা জানতো এর পরিণামে তাদের সুলতানদের কাছ থেকে শাস্তি পেতে হবে। এই অভিজাতদের কড়া হাতে দমন করা হয়েছিলো। যখন আলাউদ্দিন খলজি সুলতান ছিলেন। কিন্তু, সুলতানের শাসনে যখনই আলগা হয়ে পড়তো তখনই অভিজাতদের হাতে ক্ষমতা আকার বেড়ে যেত। সুলতানকে শুধু অভিজাতদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে চলতো না। তাকে অভিজাত ছাড়াও সুলতানকে উলেমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হতো। উলমা সুলতানকে পরামর্শ নিতো যেমন এক রাজাকে রাজত্ব চালানোর জন্য পুরোহিতরা পরামর্শ দিতে ঠিক তেমনই উলেমা বা সুলতানকে পরামর্শ দিতো কর্তৃত্বের জন্য বা শাসন করার জন্য। তবে সুলতানরা বেশির ভাগেই সময় উলেমার কথা শুনে চলতেন না। সুলতানের কাছে হিন্দু-মুসলমান সব জনগণই প্রজা, তার জন্য সুলতানকে শাসন চালাবার জন্য যা দরকার সুলতান তাই করতেন। যেহেতু সুলতানেরা মাঝে মধ্যে উলেমার কথা বা পরামর্শ মানতেন না তাই তাদের মধ্যে গোলমালও হতো। সুলতানের সিদ্ধান্তকে নাকচ করার জন্য উলেমাকেও শাস্তি দিতে পিছুপা হয়নি মুলতানেরা। সুলতানেরা নিজেদের ক্ষমতা অটুট রাখতে আমির ও উলেমার সমর্থনের প্রয়োজন হতো এবং এর জন্য সুস্তান উলেমার ও আমিরদের সমর্থনের জন্য নানান উপহার ও সান দিয়ে তাদের নিজের পাশে রাখতেন।
জিজিয়া কর ও তুরস্ক দন্ড
মুসলমান শাসকেরা অ-মুসলমান প্রস্তাদের কাছ জিভিয় কর আদায় করে থাকতেন। এই কর নেওয়া হতো মাথা পিছু এবং এই করের পরিবর্তে বা বিনিময়ে অ-মুসলমানদের জীবন, অধিকার ও সম্পত্তির সুরক্ষা দেওয়া হতো। এই অমুসলিমদের থেকে নেওয়া জিজিয়া প্রথম চালু করে খ্রিষ্টিয়া অষ্টম শতকে অনুধের সেনাপতি মহম্মদ বিন কাশিম। তিনি এই জিজিয়া কর সিন্ধু প্রদেশে পথম চালু বা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই ফিক্রিয়া কর নেওয়ার কিছু নিয়ম ছিলো। দিল্লির সুলতানিতে ব্রাম্মণ নারী, নাবালকদের, ও দাসদের এই জিজিয়া কর দিতে হতো না। শুধু তাই নয় এই জিজিয়া কর দিতে হতো না আরো অনেক ব্যক্তিদের। যেমন, গ্যাসী ও উন্মাদ ব্যক্তিরা যদি গরীব হতেন তাদের এই ডিজিয়া কর দেয়ার থেকে মুক্ত থাকতো। সুলতান আলাউদ্দিন পলক্ষ্যি উদ্দেশ্য ছিল প্রভাব শালী অ-মুসলমান ব্যক্তির আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দমন করা বা কমানো। সুলতান তালউদ্দিন খলজির এই উদ্দেশ্যর কারণ ছিলো তারা সাম্রাজ্যের মধ্যে অসন্তোষ ও বিদ্রোহকে জন্ম দিতো। কিন্তু সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক (১৩২০-২৪খ্রিঃ) এই সাম্রাজ্যের মধ্যে অন্তোষ ও বিদ্রোহকে তৈরি না করতে পারে তার জন্য একটি উপায় তিনি ধার্য করে। তিনি এমন ভাবে মিডিয়া কর অ-মুসলিম প্রজাদের ওপর চাপান যাতে কোন অ-মুসলিম প্রজার দরিদ্র না হয়ে পড়ে এবং সেই দরিদ্রতার কারণে যাতে তারা বিদ্রোহ না করতে পারে তাছাড়া আবার তার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে এবং সাম্রাজ্যের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করতে পারে। ফিজ শাহ তুঘলক খানিকটা ব্যতিকীভাবে ব্রাহ্মণদের উপরেও এই জিজিয় বর দেওয়ার জন্য আদেশ দেন।
জিজিয়াকর আদায় করতেন মুসলমান শাসকেরা অমুসলমান প্রকাদের হুছ থেকে ঠিক তেমনি তুরুষ্কদণ্ড তুর্কিদের (মুসলিমানদের উপর চাপানে ক্যা) নামে একটি কর যেটি জিঝিয়া করের মত কোন কোন হিন্দু রাজারাও চালু যা প্রচলন করেছিলো। এই ডিজিয়া কর নেওয়া হতো অ-মুসলমান প্রকাদের থেকে আর এই তুরুষ্কদণ্ড কর নেওয়া হতো মুসলমান প্রজাদের থেকে
বাজারদর নিয়ন্ত্রণ—
সামরিক শক্তির উপরেই নির্ভরশীল ছিলো সুলতান আলাউদ্দিন লজির শাসন ব্যবস্থা। শাসনকালের সময় তিনি এক বিশাল সৈন্যদল গঠন করে এবং সেই সৈনালের বেতনও তিনি ধার্য করেন। শুধু তাই নয়। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি বাজারের সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনয় দ্রব্যের দাম ঠিক করে দেন তাছাড়া তিনি সুলতান থাকাকালীন। তার আমলে দিল্লিতে চারটি বড়ো বাজার ছিলো। এই বাজারগুলিতে খাদ্যদ্রব্য, মানুষের নিত্যপ্রয়োজন জিনিস, কাপড় জামা, এমনকি ঘোড়া পর্যন্ত ক্রিয় হতো এইসব বাজারে। বাজারে বাজার দর তদারকির জন্য তিনি শাহানা– ই – মান্ডি ও ‘দেওয়ান-ই রিয়াসৎ'- নামে রাজকর্মচারীর নিয়োগ করেন। এদের কাজ হলো সুলতানদের ধার্য করে দেওয়া দামের থেকে বিক্রেতা ক্রেতাদের থেকে বেশী দাম নেয় কিনা কিংবা ওজনে ক্রেতাদের ঠকানো হচ্ছে কিনা তা দেখা শুনা করা। যদি কেউ এইরকম কাজ করতো তাহলে সেই বিক্রেতাকে সুলতানের নির্দেশ অনুযায়ী কঠর শাস্তির সম্মুখিন হতে হতো। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি তার শাসনকালে রেশন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। প্রজাদের সুলতানের পক্ষ থেকে তাদের প্রয়োজনের সময় খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পরিমান মতো প্রজাদের যোগান দেওয়া হতো।
সুলতান মহম্মদ বিনতুঘলকের অর্থিত পরীক্ষার কথা আমরা আগেই জেনেছি। সুলতান তুঘলএকর পরবর্তী মিনি সুলতান ছিলেন মানে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তিনি ইসলামের রীতি নীতি এবং উলেমাদের নির্দেশে শাসন পরিচালনা করতেন। তিনি নিজের শাসনকালের সময় বেশ কিছু জনকল্যাণকর কাজও করেছেন। তিনি নিজের রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন। ফিরোজ শাহ ইসলামীয় রীতি অনুযায়ী সেই সমস্ত কর আদায় যেতে পারে তিনি শুধু সেইসব করই প্রজাদের থেকে প্রজাদের থেকে আদায় করতেন, এবং তার শাসনকালের সময় ইসলামীয় রীতি অনুযায়ী সেই কর থাকতো তা তিনি খারিজ করেছিলেন, ফিরোজ শাহ তুঘলক তার কতুত্বর সময় অনেক ভালো কাজ করেছিলেন সেই কাজের ফলে প্রজাদের অনেক লাভ এবং তাদের জীবনজাপন সুন্দর হয়েছিলো। তিনি একাধিক নতুন নগর: মাদ্রাসা, মসজিদ বাগান এবং মূল্যবান জিনিষ হাসপাতাল তার শাসনকালের সময় তিনি তৈরি করেন। তিনি দরিদ্রের অর্থ সাহায্যেরও ব্যাবস্থা করেন, শুধু তাই নয় ফিরোজ শাহ বেকার সমস্যার সমাধানের জন্য একটি দপ্তর খোলেন। সেই দপ্তর থেকে রাজ্যের বেকার প্রজাদের চাকরি দিতেন যাতে তারা আর বেকার বা দরিদ্র না থাকে। তিনি কৃষক ভাইদের উন্নতির জন্য সেচের ব্যবস্থার উন্নয়ন করেন এবং বেশ কিছু খাল খনন করা হয় উন্নত চাষের জন্য, যেসব জমিতে চাষ হতো না সেই সব জমির সংস্কার করে উর্বর জমি তৈরি করে দিতেন সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক।
খরাজ, খামস, জিজিয়াও জাকাত।
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তার শাসনকালের সময় চার ধরনের করের প্রচলন করেছিলেন। এই চার ধরনের করগুলি হলো খরাজ, খামস, জিজিয়া এবং জাকাত।
খরাজঃ- এই কর আরোপ করা হতো কৃষিজমির উপরে।
খামসঃ এটি হলো যুদ্ধের সময় লুট করা ধনসম্পদের ওপর নেওয়া কর।
জিজিয়াঃ- মুসলিম সুলতানেরা অ-মুসলিম প্রজাদের থেকে নেওয়া করতে বলা হতো
জাজাতঃ- এটি হলো মুসলমানদের সম্পত্তির উপর আরোপ করা কর।
৪.৮. প্রাদেশিক শাসন
মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের শেষ দিক থেকেই দিল্লির সুলতানি শাসন অক্ষম হয়ে পড়ে। এই অক্ষম বা দুর্বল পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেন্দ্রীয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তির উত্থান হয়। এই সুলতানি শাসন উল্লেখযোগ্যের মধ্যে হলো বাংলায় ইলিয়াসশাহি এবং হোসেন শাহি শাসন, এবং দক্ষিণ ভারতে বিজয়নগর এবং বহমনি রাজ্যের শাসন।
৪.৮.১. বাংলায় ইলিয়াস শাহি ও হোসেনশাহি শাসন–
যখন দিল্লির সুলতানি শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন কেন্দ্রীয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করা হয় এবং কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তির উত্থান হয়। শমউদ্দিন ইলিয়াস ১৩৪২ খ্রিঃ লখনৌতির সিংহাসন দখল করেন। শামউদ্দিন ইলিয়াস বাংলার প্রধান তিনটি রাজ্য লখনৌতি, সোনারগ এবং সাতগাঁয় তিনি নিজের শাসন শুরু করেন। তিনি ইলিয়াস শাহ পূর্ববশ এবং কামরূপকে নিজের শাসনের আওতায় নিয়ে আসেন। ইলিয়াসের রাজধানী পাণ্ডুয়াকে তিনি দখল করন এবং এই সময় দিল্লিতে তখন ফিরোজ শাহ তুঘলক শাসন করেছিলেন
দুর্ভেদ্য - একডালা - দূর্গ
যখন ফিরোজশাহ তুঘলক পান্ডুয়া আরহণ করেন সেই সময় একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন ইলিয়াস শাহ। এই দুর্গটি ঘিরে ছিলো গলার দুই শাখা নদী–চিরামতি ও বালিয়া। কিন্তু আজ এই দুর্গটির কোন চিহ্ন নেই। এই দুর্গটি– গৌড় থেকে খুব বেশি দূরে ছিলা না এবং এই দুর্গটি প্রায় দুর্ভেদ্য ছিল। ফিরোজ শাহ ও ইলিয়াস শাহর সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। সে সময় ফিরোজশাহ ইলিয়াস শহকে ঠকানোর জন্য তিনি সৈন্য সমেত ফিরে যাওয়ার নাটক করেন। ইলিয়াসশাহ তার এই পাতা ফাঁদে পড়ে গিয়ে সৈন্য নিয়ে একডালা দূর্গ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং তিনি ফিরোজ শাহকে পিছন থেকে আক্রমণ করতে যায়। যার ফলে ইলিয়াসের পরাজয় হয় এবং যুদ্ধে দিল্লির সুলতানের জয় হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরোজ শাহ একডালা দূর্গ দখল করতে পারনি। আর এই জন্যই বাংলায় শাসক হিসাবে থেকে গেলেন সুলতান ইলিয়াস শহই।
বাংলার সুলতানি শাসন কে প্রতিষ্ঠা করেন
বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান হলেন সুলতান শামউদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮ খ্রিঃ)। সুলতান শামউদ্দিন ইলিয়াস শাহ যিনি দিল্লির সুলতানি শাসনের আওতার বাইরে এই স্বাধীন শাসন তৈরি করেন।
ফারসি কাব্যের একজন সমঝার ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। সুলতান গিয়াসউদ্দিনের শাসনকালের সময় বাংলার সামুদ্রিক বাণিজ্ঞা খুব ভালো হয়েছিলো।
সুলতান জালালউদ্দিন মহম্মদ শাহ তিনি জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন, কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার শাসন কালের সময় (১৪১৫-১৬.১৪১৮-৩০ খ্রিঃ) পর্যন্ত।
সুলতান জালালউদ্দিনের শাসনকালের সময় বাংলর রাজধানী মালদহের হজরত পাওয়া থেকে গৌড়ে চলে আসে।
অনেকর ধারণা যে পরবর্তী ইলিয়াসশাহি সুলতানরা ছিলেন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াসশাহর বংশধর।
বাংলায় আবিসিনীয় সুলতানেরা শাসন করেছিলেন ইপিয়াসশহি এবং হোসেন শাহির শাসনের মাঝে। আবিসিনীয় সুলতানের বাংলায় শাসন করতে এসেছিলেন আফ্রিকার আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া থেকে। এই আবিসিনিয়াদের বাংলায় হাবশি বলা হতো।
আফগানের নেতা শেরখানের আক্রমনের পর ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সুলতানি শাসন শেষ হয়।
আরও পড়ুন - সুলতান শাসন নিয়ে বাছাইকৃত ১০০ টি প্রশ্ন
মন্তব্যসমূহ