জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি সুলতানি ও মুঘল যুগ বিষয়বস্তু । class 7 chapter 7 history

 সপ্তম অধ্যায়

জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি 
সুলতানি ও মুঘল যুগ

জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি class 7

 জীবনযাত্রা : ইতিহাসের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যায় কারা? 

এ বিষয়ে একটাই উত্তর সাধারণ মানুষ, যারা হাটে-মাঠে নিত্য ঘাম ঝরায়। রাজা শাসক সুলতান বাদশা প্রধানমন্ত্রী উজির তাদের কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় থাকে, অবহেলিত হয় শ্রমিক কারিগর কৃষিজীবি মানুষ। এখন পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। সুলতানি ও মুঘলযুগে সাধারণ মানুষের অবস্থা কেমন ছিল। এইযুগে বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করত। বড়ো শিল্প কিছু ছিল না, কারখানা বলতে যা বোঝায় তা তো ছিল না, কৃষিভিত্তিক কিছু শিল্প গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে নদীর তীরে বাংলা, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে কিছু শিল্প গড়ে উঠেছিল। চাষি চাষ করত সেই ফসলের একটা নির্দিষ্ট অংশ শাসক শ্রেণিকে পৌঁছে দিতে হত, বিনিময়ে তার নিরাপত্ত পেত। গাঙ্গেয় সমভূমি ছিল সবচেয়ে উর্বর, তাই এখানে নানা ধরনের ফসল ফলত, যেটুকু শিল্প গড়ে উঠেছিল তা ছিল কৃষিভিত্তিক। এককথায় বলা যায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল এখানে। উল্লেখযোগ্য ফসলের মধ্যে ছিল আম, জাম, কাঁঠাল কলা নারকেল, আঙুর,খেজুর নানা ধরনের ফুল পাওয়া যেত। এর সঙ্গে ছিল চন্দন কাঠ, ঘৃত নানা বৈচিত্র্যের ভেষজ উদ্ভিদ নানা ধরনের মশলা, লঙ্কা, আদা, পেঁয়াজ রসুন জিরে অন্যান্য মশলা ও চাষ হত। প্রচুর পশু-পাখিও পাওয়া যেত। গ্রামে যে সমস্ত কুটির শিল্প গড়ে উঠেছিল সেগুলি ছিল কৃষিভিত্তিক। এইরকম দুই একটি শিল্প হল, আতর শিল্প, চিনি শিল্প, সুগন্ধী দ্রব্য প্রস্তুতকারী শিল্প। এদের মধ্যে কিছু শিল্প ছিল একান্তই বংশগত। এই সময় যে কটি বড়ো শিল্প দেখতে পাই তার মধ্যে রয়েছে বস্ত্রশিল্প, বিভিন্ন ধাতুর কাজ, পাথরের কাজ, কাগজ শিল্প। কুটির শিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রং শিল্প, সুচিশিয়া, সুতো তৈরি প্রভৃতি। গুড় পাটালি, সন্দেশ, সার শিক্ষ, সুপারি কাটা শিল্প প্রভৃতি। রাজমিস্ত্রি পাথরের কাজে দক্ষ মিস্ত্রির চাহিদা ছিল খুব বেশি। বাড়ি তৈরি জন্য ইটের ব্যবহার শুরু হয়েছিল বাংলা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। এই সময় টালির ব্যবহার ও শুরু হওয়ায় এটিও শিল্প হিসাবে স্থান করে নিয়েছিল, নি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সর্বত্র সমান ছিল না, সঠিক সময়ে বৃষ্টি না হলে খরা বা বন্যা হলে, তবে সবচেয়ে সপ্তায় মানুষ জিনিস পেয়েছিল ইব্রাহিম লোদীর আমলে জানা যায় একটা বহুকোটি মুদ্রা দিয়ে মানুষ বিপুল কেনাকাটা করতে পারত। যেমন একটি মুদ্রা দিয়ে দশমন খাদ্যশসা, পাঁচসের তেল, এবং দশগা মোটা কাপড় কিনতে পারত। জিনিসপত্রের গুণমান ছিল অসাধারণ। সমাজ ছিল যৌথ পরিবার ভিত্তিক। কঠিন শাসনে বাঁধা। পরিবারের সবচেয়ে বয়োসজ্যেষ্ঠ ছিলেন সংসারের চালক, তবে বাড়িতে পুরুষদের কর্তৃত্ব ছিল বেশি তুলনায় মেয়েদের স্থান ছিল অনেকটাই নীচে। উঁচু শ্রেণি হিন্দু মুসলমান উভয় গোষ্ঠিতে পর্দা বা ঘোমটা দেওয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে ওসব কিছু ছিল না। গরীব বৃহক পরিবারে নারীপুরুষ উদয় অস্ত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিশ্রম করত তবেই একমুঠো খাবার জুটত। মাছ-মাংস ছিল তাদের কাছে অধরা। তাই পর্দা বা ঘোমটার বিলাসিতা তাদের কাছে ছিল না। সাধারণ মানুষ খুব কম খরচে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিজেরাই জোগাড় করে নিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় খুব কম খরচে ও সামান্য উপকরণ দিয়ে তারা বসতি গড়ে তুলত। যেমন কুয়ো খোঁড়ার সুযোগ বা ছোটখাটো পুকুর; ডোবা পেলেই তার ধারে তারা বসতি নির্মাণ করে নিত, ঘর তৈরির উপকরণ হিসাবে নিত গাছের গুঁড়ি, চাল ছাইবার জন্যে তার ব্যবহার করত ছড় না হয় তালপাতা। দেওয়াল তোলার জন্য ব্যবহার করত কাদামাটি অথবা পাথর। সাধারণ মানুষ দিন রাত পরিশ্রম করলেও উপযুক্ত খাদ্য জোটাতে পারত না। জাহাঙ্গীরের আমলে এক ওলন্দাজ বণিকের লেখা থেকে দেখা যাচ্ছে যে গরিবরা মাংসের স্বাদ প্রায় জানতই না। তাদের রোজগারের খাবারের তালিকায় থাকত এক ধরনের বিচুড়ি তাও সারাদিনের মধ্যে একবারই মাত্র খেতে পেত। বিলাসব্যসনের ধারকাছ দিয়ে তারা যেত না, পরার জন্য তাদের কাছে উপযুক্ত জামাকাপড় ছিল না একটা পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে তাদের কাছে সম্পত্তি বলতে ছিল একজোড়া খাটিয়া, রান্নার জন্য দুই একটি বাসন, মাটির হাঁড়ি, বিছানার চাদর এগুলিকেই তারা শীতকালে বন্ধুরূপে ব্যবহার করত। গ্রীষ্মকাল কোনো রকমে কাটলেও শীতকালে কষ্টের সীমা পরিসীমা ছিল না। বিভিন্ন মেলা পার্বন উৎসব হলে সাধারণ মানুষের জীবনে একটু আপদের ছোঁয়া লাগত। একদিকে রাজা অভিজাতরা প্রচুর ধন সম্পত্তির মালিক আর সাধারণ মানুষ নিঃস্ব অসহায়। যনি বা সম্রাটরা জলের মতো অর্থ সম্পদ ব্যয় করত, দূর্গ মসজিদ মাদ্রাসা আগাফোর্ড তাজমহলের মতো স্থাপত্য নির্মান করত চোখ ধাঁধানো পোশাক দামি খাদ্যের ব্যবহার করত। এই যুগে যেমন খেলাধুলা, ভীষণ জনপ্রিয় সেযুগেও বিভিন্ন ধরনের জনপ্রিয় খেলা ছিল। সবচেয়ে জনপ্রিয় কুস্তি সাধারণ মানুষ বটেই সাধুসওরাও এই মেলায় অংশ নিত। এছাড়া সাঁতার তীর ধনুর বর্ণা ছোঁড়া জনপ্রিয় ছিল। বাংলায় আর এক ধরনের খেলা চালু ছিল তাহল বাঁটুল ছোঁড়া, লোক গান নাচ, বাজিকর বা জাদুকরের খেলা সংসজ্জা এগুলিও সাধারণ মানুষ উপভোগ করত। বিভিন্ন শাসক বদলেছে বদলায়নি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, উদয় অস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর অভাব এই ছিল তাদের নিত্য সঙ্গি।


সুলতান কালের সময় মাপা:

 দিন রাতের সময় বোঝাবার জন্য সমস্ত দিন রাতকে ৮টি প্রহরে ফারসি ভাষায় পাশ বলা হত। বর্তমান হিসাব অনুসারে এক একটি প্রহরের অর্থ ৩ ঘণ্টা। আটটি গ্রহর আবার ৬০টি ঘড়িতে বা ঘণ্টায় বিভক্ত ছিল। এক ঘড়ি সমান ছিল আজকের চব্বিশ ঘণ্টা প্রতিটি ঘড়ি ছিল ষাটটি পলেবিভক্ত, এইভাবে দিন রাত মিশিয়ে তিন হাজার ৬০০ পন ছিল। পাঁজির সাহায্যে প্রহর ঘড়ির যথাযথ সময় বুঝে নেওয়া হত। শহরের মধ্যে বড়ো ঘণ্টা বসান থাকত, সেই ঘণ্টা বাজিয়ে শহরের লোকজনকে সময় দেওয়া হত। কথিত আছে সুলতান ফিরোজ শহরে আসলে সময় জানানোর জন্য একটি দপ্তর ছিল।

নতুন লোকায়ত ধর্মীয় ভাবনা ভক্তি ও সুফিবাদ : 

মধ্যযুগেও ধর্ম ছিল মানুষের চালিকা শক্তি রখন্যবাদ বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রভৃতি ধর্ম সমাজে প্রচলিত থাকলেও এই সময় সুফি ও ভক্তি ধর্মের প্রচলন শুরু হয়। ভক্তের সঙ্গে ভগবানের আত্মিক সম্পর্কের কথাই প্রচার করা হয়েছে। এ ছিল এক নতুন ধরনের মতবাদ।


জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি  সুলতানি ও মুঘল যুগ বিষয়বস্তু । class 7 chapter 7 history


ভক্তিবাদের মূল কথা কি ছিল ? ভক্তিবাদের উত্থানের কারণ কি ছিল ? 

ভক্তিবাদের মূলকথা ছিল, ভগবানের প্রতি ভক্তের ভালোবাসা, এই ধর্মের দুটি দিক ছিল (১) ভগবানের কাছে ভক্তের পুরোপুরি আত্মসমর্পন। (২) ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য জ্ঞান বা যোগ ছেড়ে ভক্তের ভক্তিকেই প্রাধান্য দিতে হবে। এই বৈশিষ্ট্যই উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে প্রধান হয়ে ওঠে। ভক্তিবাদের উত্থানের পিছনে নানা কারণ ছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক নাগাদ হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর রাজপুতরা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে, এই সময় রাজপুত এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের একটি চুক্তি তৈরি হয় এর ফলে ব্রাহ্মণ্যদের নির্দেশ অনুযায়ী কোনো নতুন ধর্ম এখানে দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। এই নতুন সৃষ্টির জন্য নাথপন্থি, যোগী ইত্যাদি ধর্মী গোষ্ঠি গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের অলভার এবং নায়নার সাধকরা বিখ্যাত হয়ে ওঠে, এদের হাত ধরেই দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। ব্রহ্মণ্য ধর্ম ক্রমশ পিছু হটতে থাকে কারণ এই ধর্ম ক্রমে আচার সর্বস্য ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছিল, অপর দিকে বৌদ্ধ ও জৈন্যধর্ম ও নিজেদের স্থান ধরে রাখতে পারছিল না, কারণ অযথা রীতিনীতির উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ার ফলে মানুষের তা অপছন্দ হতে থাকে, যারা এই নিয়ম কানুন তৈরি করেছিল তারা চুড়ান্তভাবে অ-সাংসারিক জীবন যাপন করত। এই ধর্মে না ছিল ভক্তি না ছিল ভালোবাসা, না ছিল ভালো থাকার চাবিকাঠি। এই রকম অবস্থায় সরল সহজ স্থানীয় তামিল ভাষায় ঈশ্বরের উপর ভক্তি ও ভালোবাসার কথা জানায়। অলভার এবং নায়নার সাধকরা, তাদের প্রচারে সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হয়। তবে ধীরে ধীরে ভক্তিবাদ তার স্থান হারাতে থাকে, কেননা ভক্তিবাদেও দেবপূজাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করা হতে থাকে। তবে একথা ঠিক যে ভক্তিবাদ কখনই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সাথে পাল্লা দিতে পারেনি। সে ক্ষমতাও তাদের ছিল না। ক্রমে ভক্তিবাদের ধারা উত্তর ও পূর্ব ভারতে এসে পৌঁছায় তুর্কীদের আক্রমণে রাজপুতরা দুর্বল হয়ে পড়লে তাদের ক্ষমতা ক্রমশ কমে আসে ফলে সমাজে তাদের যে সামাজিক এবং ধর্মীয় জীবনে রামদের যে দাপট ছিল তা কমে আসে। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে নামদেব, আনেশ্বর, তুকবাম, দাদু, মীরাবাই, কবীর নানক, চৈতন্যদের সবাই ভক্তিবাদের প্রচার শুরু করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শুধু মানুষ কথা প্রচার। রচিত হয় মানুষ নিয়ে গান লেখা কবিতা গান রচনা করা যা আগে কখনো হয়নি। তখন রাহুণ্যদের ধর্ম বিষয় ছাড়া অন্য কিছু রচনা করা যেত না। তবে ভক্তি সাধকদের চিন্তা ধারার মধ্যে পার্থক্য ছিল। তবে সব সাধকদেরই ভক্তি দর্শনের মূল কথা ছিল দুটি। একটি হল, সব মানুষ সমান, মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য নেই ঈশ্বরের প্রতি সকলের সমান অধিকার। সব মানুষের কাছে ঈশ্বরের বাণী পৌঁছে দিতে হবে। অপর হল আচার সর্বস্যতা ছেড়ে ভগবানকে নিজের মতো করে পাওয়া। এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ মীরাবাঈ। তাঁর রাজস্থানের একটি ক্ষত্রিয় বংশে জন্ম হয়। মেওয়াড়ের রাজবংশে তার বিয়ে হয়। তিনি তার সাধিকা জীবনের বেশির ভাগ সময়টা কাটান গুজরাটের দ্বারকায়।" শ্বশুর বাড়ির প্রতিকূলতা কাটিয়ে তিনি তার সমস্ত জীবন শ্রীকৃষ্ণের সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন। পাঁচশতের বেশি ভক্তি সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। মীরাবাঈ-এর সঙ্গীত ধারায় উঁচু জাতি নীচু জাতি সকলেই ভেসে ছিল, সন্ত রামনন্দের শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন চামার রবিদাস নাপিত সাই বা কসাই।

● মনে রাখতে হবেঃ মধ্যযুগে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত হত ধর্মের দ্বারা, উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি হিসাবে ব্রাহ্মণ সমাজের প্রতিটি শ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করত। অ-ব্রাহ্মদের কোনো অধিকার ছিলনা। তারা না পেত স্বাধীনভাবে ধর্মাচারণের অধিকার, না পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠের অধিকার, এমন কি মন্দিরে যাওয়ারধিকার পর্যন্ত তাদের ছিল না, অন্য বর্ণ বা জাতির সাথে এক সাথে বসে খাওয়া, নিজেদের মধ্যে বিয়ে করার অধিকার ছিল না।



 গুরু নানক (১৪৬৯-১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ): 

গুরু নানক ছিলেন মধ্যযুগের অন্যতম ভক্তি সাধক। তিনি মনে করতেন, সব মানুষ সমান, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সেইজন্য তিনি চালু করেছিলেন সব মানুষ এক সঙ্গে বসে খাবে, একে বলা হত লঙ্গরখানা। তার দর্শন ও বাণীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শিখ ধর্ম। এই ধর্মে ১০জন গুরুর কথা পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রথম ছিলেন গুরু নানক। গুরুদের বাণী লেখা আগে শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে, যার নাম গ্রন্থসাহেব, বা গ্রন্থসাহব, গুরুদের বাণীগুলি স্থানীয় গুরমুখি লিপিতে লেখা।

 কবীর (১৪৪০-১৫১৮ খ্রিস্টাব্দ) 

খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ—ষোড়শ শতকের অন্যতম ভক্তি সাধক ছিলেন কবীর। তিনি ছিলেন রামানদের শিষ্য। তবে এই মতভেদ, কথিত আছে তিনি মুসলমান জোলার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। তাঁর কাছে সব ধর্মই ছিল, তবে রাম-রহিম-ভগবান-আল্লাহ-হরি-গোবিন্দ-সাঁই-সাহেব সবই এক এবং অভিন্ন। ভগবান পেতে হলে মনের ভক্তি যথেষ্ট, তাকে পেতে মন্দির মসজিদ গুরুত্বার কোথাও যাবার দরকার নেই। তিনি বিশ্বাস করতেন ভক্তি দিয়েই ভগবানকে পাওয়া যায় তখন সমাজকে ভাবনায় কবির এই মত ছিল কুবই গুরুত্বপূর্ণ তাঁর গান দৌঁহা শুনলে বোঝা যায় তিনি কীভাবে লোক দেখানো আচারের বিরোধিতা করেছেন। হিন্দিতে রচিত ছোটো ছোটো পদগুলিকে বলা হত দোঁহা।

 পির ও মুরিদ : 

সুফিবাদ ছিল গুরুবাদী একটি সাধন দারা, সুফি সিক শিলাগুলির যিনি প্রধান হতেন। তিনি হতেন কোনো সাপক। তিনি তার শিষ্যদের সঙ্গেই দিনরাত অতিবাহিত করতেন। তাদের থাকার স্থানকে বলা হয় আশ্রম বা খানকা সুফি ধারায় গুরুকে বলা হয় পীর এবং মুরিদ অর্থাৎ শিষ্যের সঙ্গে সম্বন্ধ ছিল খুবই গুরু চরণ। গুরু তাদের দর্শন চিন্তার ফসল দিয়ে যেতেন উপযুক্ত শিষদের হাতে তাদের বলা হত খানকা বা উত্তরাধিকারী।

কবীর ছিলেন অন্যতম ভক্তিবাদী সাধক তিনি প্রায় পাঁচশত দোঁহা রচনা করে গেছেন শিখ এবং ধর্মের মানুষ তাঁর এই দোঁহার প্রতি শ্রদ্ধা ছিল। দোঁহার সহজ সরল ভাষার মধ্যে দিয়ে তিনি প্রচার করতেন কীভাবে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে। সাধরণ মানুষ তাঁর দোঁহার খুব ভক্ত ছিলেন, মজুর-কুলি চাষি-মোড়ল—সবার মুখের ভাষাই ছিল দোঁহার ভাষা, জনশ্রুতি আছে তার মৃত্যুর পর তার দেহ কীভাবে সৎকার করা হবে তাই নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় কবীরের দেহটি নেই আর সেই স্থানে আছে এক মুঠো লাল গোলাপ একটি ফুল দুই সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। এই ঘটনাটির কথা সত্যতা বিচার না করেও বলা যায় তখনকার মানুষের কাছে কবীর কতটা স্রদ্ধাশীল ছিলেন।

সুফিবাদ কাকে বলে ? সুফিবাদের উদ্ভব ও প্রসার আলোচনা কর।


সুফিবাদ : ঈশ্বর মানুষের মধ্যে বাস করেন, মন্দির বা মসজিদে নয়, ভক্তি থাকলেই তাকে নিজের ইচ্ছামতো ডাকা যায় এই ইচ্ছা শুধু হিন্দু বা বৌদ্ধ সহজিয়াদের মধ্যে নয় খ্রিস্টীয় দশম একাদশ শতক থেকে ধর্মীয় বিধি নিষেধকে সরিয়ে রেখে বহু মুসলমান নিজের মতো আল্লাহের উপাসনার রাস্তা অনুসন্ধান করছিলেন–তাদের পথ দেখে সুফি সম্ভগণ। সুফির উদ্ভব হয় মধ্য-এশিয়ায়, সম্ভবত তারা খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতক থেকে ভারতে আসতে থাকে। ত্রয়োদশ শতকের মাঝাশঝি সময় থেকে  সফিবা ভারতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সফি শব্দের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ মনে করেন সুফি কথাটি আসে সুফ থেকে যার অর্থ আরবিতে পশমের তৈরি এক টুকরো কাপড়, পশমের তৈরি কম্বল জাতীয় জিনিস গায়ে দিতেন সুফিরা, শুধু তারা নন খ্রিস্টান সম্ভর। এই কম্বল গায়ে দিতেন, সুফিবাদ প্রচারের পাশাপাশি এই সময় ভক্তিবাদ নাথপন্থি ও যোগীরা তাদের ধর্ম প্রচার করছিলেন তাই একথা বলা যায় যে এই ধর্মগুলি একে অপরকে প্রভাবিত করেছিল। সুফিরা হঠযোগ অভ্যাস করত সম্ভবত তারা যা জেনে ছিল নাথপন্থিদের কাছ থেকে, এদেশে সুফিদের দুটি গোষ্ঠি ছিল। একটি দিল্লি ও গঙ্গা-যমুনা-দোয়ার অঞ্চলে থাকত এবং সিন্ধু-পঞ্জাব ও মুলতানে সুহরাবর্দিরা ভারতে চিসতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মইনউদ্দিন চিলতিশেখ নিজামুদ্দিন আউলিয়া ছিলেন সিলসিলা গোষ্ঠির সাধক। তার অপর নাম ছিল বখতিয় একাকি। সুফি ছিলেন সহজ সরল খোলামেলা স্বভাবের মানুষ, তারা মানুষের সাথে মিশতে পারতেন, তাদের সুখ দুঃখে পাশে থাকতেন। এই সাধকরা ধর্ম অর্থ ক্ষমতার মাপকাঠিতে মানুষকে মাপতেন না। সবচেয়ে বড়ো কথা তারা নিজেদের দরকারি রাজনীতি থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখতেন। তারা কষ্টের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তবে সুহরাবদী সুফিবা উপঢৌকন নিতেন সরকারি উচ্চপদও দু-একজন গ্রহণ করতেন। তারা গোষ্ঠি বন্দে অংশ নিতেন। যাইহোক না কেন ভারতীয় সমাজে সুফি সাধকদের অবদান ছিল অসীম, নিজেদের জীবনদশের মধ্যে সব মানুষ একত্রে শান্তির সাথে যাতে তারা বসবাস করতে পারে সেই চেষ্টাই করতেন। সাধারণ মানুষ নিশ্চিতে তাদের প্রতি ভরসা করতেন। সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায় সাধারণ মানুষের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। ঈশ্বরলাভের একমাত্র উপায় মনের ভক্তি দিয়ে ভগবানকে ডাকা, শিক্ষা-সংস্কৃতির উপরও এদের প্রভাব দেখা যায় বিভিন্ন দোঁহা, কবিতা, কীর্তন এবং নানা নৃত্যশৈলীতে সেই ছাপ আজো খুঁজে পাওয়া যায়।

 শ্রীচৈতন্য ও বাংলার ভক্তিবাদ


 শ্রীচৈতন্য ও বাংলার ভক্তিবাদ: সমাজ সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রভাব: বাংলার সাংস্কৃতিক সমাজ, ধর্মীয়। অর্থনৈতিক, জীবনের প্রতিটি পর্বেই মধ্যযুগে যে ব্যক্তির আলোচনা না হলে ইতিহাস পর্যালোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় তিনি হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের প্রচার প্রসার অন্য মাত্র পায়। শ্রীচৈতন্যদেব ও তার সম্প্রদায়ের চেষ্টায় জাতি-ধর্ম-বর্ন এইসব ভেদাভেদের বিরুদ্ধে বৈয়ব ভক্তির প্লাবন জনজীবনকে প্লাবিত করে যায়। নবদ্বীপ ছিল ভক্তি আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এই সময় নগরের বাসিন্দাগণের মধ্যে অব্রাম্ভণরাই ছিলেন সংখ্যায় বেশি। তুর্কী আক্রমণের বাংলায় নানা পরিবর্তন শুরু হয়। বিশেষ করে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু হয়। বাংলায় ক্ষমতায় আসেন হোসেন শাহি বংশ, তার আমলে ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি কমে কায়স্থদের প্রভাব বাড়ে। এর সাথে চলে শাসক ও আমলাদের প্রবল অত্যাচার, প্রচলিত হিন্দুধর্ম এই অত্যাচারের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে পারেনি। অনেকে হিন্দু ধর্মের মায়া ছেড়ে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন, কেউ কেউ তন্ত্রসাধনায় মান দেন। এছাড়া সাধারণভাবে মনসা চন্ডী ধর্ম এসব কিছুর দেবদেবীর পূজার চল ছিল। বাংলায় বিশেষ করে নবদ্বীপে যা পরিবেশ ছিল, তা ভক্তি ধর্ম প্রচারের অনুকূল ছিল না। একদিকে ব্রাহ্মণদের তীব্র বিরোধিতা উপবাস, ভক্তিবাদ ও বৈষুবদের যেমন সহ্য করতে হত। এর পাশাপাশি শাসকদের অত্যাচারও কম ছিল না। শ্রীচৈতনা এবং তার অনুগামীরা সহজ সরল পথকে বেছে নিয়েছিলেন। সেটার ছিল অন্তরের ভক্তি, ভক্তি আসে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে তার জন্য কোনো উপাচার লাগে না, লাগে না কোনো অর্থ, আড়ম্বর, যাগযজ্ঞ নয় নিষ্ঠ। অনুরাগ শ্রদ্ধা ছিল বৈষুব ধর্মের মূল কথা, শ্রীচৈতন্যদেবের পতিত জনের প্রতি ভালোবাসা সকলের প্রতি শ্রদ্ধা, সর্বপরি উদার দৃষ্টি ভঙ্গির জন্য বৈয়ব ধর্মের জোয়ারে গোটা বাংলা ভাসতে শুরু করে। চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন:

“নীচ জাতি হৈলে নহে ভজনে অযোগ্য

যেই ভজে' সেই বড়ো অভন্ত হীন ছাড়া। 

কৃষ্ণ জ্ঞানে নাহি জাত কুলাদি বিচার।। 

এই পদ থেকে বোঝা যায় সাধারণ মানুষ সম্পর্কে ভক্তি আন্দোলনকারীদের মনোভাব জানা যায়, চৈতন্যের বৈষুব ভক্তি ধর্ম প্রচার ও প্রসারের একটি পরিকল্পিত কাঠামো ছিল তা নীচে আলোচনা করা হল।

প্রথমত, চৈতন্যের নেতৃত্বে যে বৈষুব গোষ্ঠী সংগঠিত হয় তা ছিল শুধু ভক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে জাতপাতের কোনো বিচার ছিল না।

দ্বিতীয়ত, শ্রীচৈতন্যদেব তার ধর্মের আড়ম্বরপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠান রাখেন নি, তার ধর্ম প্রচারের মূল হাতিয়ার ছিল সংগিত। তিনি ঘরে ঘরে নাম গান প্রচারের ব্যবস্থা করেন। সেই প্রচারের দলে জাতপাতে স্থান ছিল না।

সব বর্ণের সব ধর্মের মানুষ এক সাথে এক জোট হয়ে নগর কীর্তনে বের হত, স্বয়ং চৈতন্যদেব সুমধুর কীর্তন গাইতেন।

তৃতীয়ত, চৈতন্য নিজে ছিলেন উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ কিন্তু বিভিন্ন পেশা তথাকথিত ছোটো উঁচু জাত বা নীচু জাত সবার সাথে তার সুন্দর যোগাযোগ ছিল। তার ডাকে সবশ্রেণির মানুষ এক পতাকাতলে এসে দাঁড়িয়েছিল।

চতুর্থত, তৎকালীন সমাজে যেসব ধর্ম প্রচলিত ছিল চৈতন্যদেব সরাসরি তাদের সাথে বিরোধিতার যাননি, শুরুতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে সংগঠনটি অচিরেই বিনাশ হতে পারত। ভক্তি তার ধর্ম প্রচারের মূল অস্ত্র হলেও ভক্তি প্রচারকেই একমাত্র ধর্ম হিসাবে তুলে ধরেন নি।

পঞ্চমত, ধীরে ধীরে ভক্তি আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে তিনি নবদ্বীপের অত্যাচারী শাসক জগাই মাধাই-এর অত্যাচারের প্রতিবাদ করেন। চৈতন্যদেবের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর বিশস্ত অনুগামী নিত্যানন্দ। কীর্তনের বিরোধিতা শুরু হলে স্বয়ং চৈতন্যদেব এই তৎকালীন কাজীকেও তর্ক যুদ্ধে হারিয়ে দেন, তারা ক্রমশ হিন্দু মুসলমান অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন।

ষষ্ঠত, শুধু গান বা সংকীর্তন নয় নাট্য অভিনয়ের মধ্য দিয়েও তিনি বৈবধর্ম প্রচারের উদ্যোগ নেন, চৈতন্যদেব স্বয়ং নাটকে অভিনয় করেন।

সপ্তমত, ভক্তি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল স্থানীয় ভাষাকে অবলম্বন করে। চৈতন্যদেব ও বাংলা ভাষাতেই বৈয়ব ধর্ম প্রচার করেন।


ভক্তি আন্দোলনের ফলাফল ও গুরুত্ব- 

  ভক্তি আন্দোলনের ফলাফল : সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব কমে আসতে থাকে। যে-কোনো পরিবর্তন ধীরে ধীরে শুরু হয়। সেটা বৈষুব ভক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য সমাজের বুকে দীর্ঘদিনের চেপে বসা অস্পৃশ্যতা কুসংস্কার জাতিভেদ প্রথা সমাজ থেকে একেবারে উঠে গেল তা নয়, কিন্তু পরিবর্তনের শুরু হয়ে গেল, কালে কালে তা অনেকটাই হালকা হয়ে গেল। তবে এটা সত্যি যে সামাজিক ভেদাভেদ পুরো দূর না হলেও তা অগ্রাহ্য করার সাহস মানুষের মধ্যে অর্জিত হয়েছিল। বৈষ্নবদের নানা রচনায় তখনকার দিনের রোজনামচা ধরা পড়ে। শুধু ভক্ত হিন্দু কবিরা নয় বহু মুসলমান কবিও বৈঘ্নর সঙ্গীত রচনা করুন। খাঁটু-খ'টু-তেলেনাপটুয়া, রামলীলা, পৌষ-পার্বন ইত্যাদির গানে আজও বৈয়ব প্রভাব দেখা যায়। শ্রী চৈতন্যদেবকে ঘিরে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে। এক নবসংস্কৃতির পরিবেশ তৈরি হয়। নতুন করে সংগীত রচনা, সাহিত্য রচনা শুরু হয়, বাহ্যিক আড়ম্বরের বদলে ভক্তির মাধ্যমে কীভাবে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যায় তা প্রশস্থ হয়। সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছিল ভক্তি না থাকলে চৈতন্যকে পাওয়া যাবে না। উচ্চ বংশ বা কূলে জন্মগ্রহণ করে শাস্ত্রচর্চা করলে কিছু হবে না, একমাত্র ভক্তির মধ্যেই চেতনা লাভ সম্ভব।


দীন-ই-ইলাহি কি ? দীন ই ইলাহির মূল কথা কি ? দীন ই ইলাহি বৈশিষ্ট্য ?

 দীন-ই-ইলাহি : আকবর নিজে মুসলমান হলেও কখনো গোঁড়া ছিলেন না। তার পরমত সহিষ্ণু মনোভাব তাকে জাতীয় সম্রাটে পরিণত করেছিল তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন তার দীন-ই-ইলাহি ধর্ম প্রবর্তনের জন্য, আকবর ফতেপুর সিক্রির প্রসাদে সকল ধর্মের গুরুদের ডেকে পাঠাতেন। তাদের ধর্মের মূল কথা শুনতেন। ধীরে ধীরে তিনি সমস্ত ধর্মের সারবস্তু গ্রহণ করেন। তারপর নিজের আচরণে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন খ্রিস্টিয় ১৫৭০ এর দশকে বাদশাহ আকবর সবার সামনে নামাজ পড়া অন্যান্য ইসলামীয় নিয়মবিধি পালন বন্ধ করে দেন এবং নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন প্রথা পদ্ধতি চালু করার চেষ্টা করেন। এক সময়ে দিনে চারবার পূর্ব দিকে মুখ করে সূর্য প্রণাম করা এবং সূর্যের নাম জপ করা, উলেমা হিন্দু পারসি প্রভৃতি গুরুদের মতামত পর্যালোচনা করে, তিনি এক নতুন ধর্মমত চালু করেন, তার নাম দেন দীন-ই-ইলাহি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দীন-ই-ইলাহি কি নতুন ধর্ম, এমন নিত্য নতুন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এটি নতুন কোনো ধর্মমত নয় কারণ আকবর কোনোদিন ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করেননি। আকবর ইসলাম ধর্মের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও যুক্তিগ্রাহ্য সেই মতটি মেনে নিতেন এবং অন্যান্য ধর্ম থেকে নিজের পছন্দ মতো বৈশিষ্ট্যগুলিকে ভিত্তি করে তিনি দীন-ই-ইলাহি তৈরি করেন। সুতরাং দীন-হি-ইলাহি হল সর্ব ধর্মের সম্মেলন। বর্তমানে অবশ্য দীন-হি ইলাহি সম্বন্ধে ধারণা খানিকটা আলাদা, আকবর তার ধর্মমত প্রচার করেছিলেন সভাসমূদ্ধের মধ্যে, তিনি নিজে তার বাছাই করা অনুগত অভিজ্ঞাত সভাসদদের ও অভিজাতদের মধ্যে এই ধর্ম প্রচার করতেন বেশ কিছু অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির মধ্যে তারা বাদশাহের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন জানাত এবং অনুগত থাকার শপথ নিত। এই হল দীন-ই-ইলাহি। এই ধর্ম প্রবর্তন করে আকবর তার চারিদিকে একটা সুরক্ষা বলয় গড়ে তুলেছিলেন। বলয়ের সদস্যরা এসেছিলেন এক এক ধর্ম থেকে তারা কেউ হিন্দু কেউ পারসিক, কেউ রাজপুত বা ভারতীয় মুসলমান, দীন-ই-ইলাহি কোনো আলাদা ছিল না।শুধু আকবর নয় জাহাঙ্গিরের সময়েও এই ধর্মমত চালু ছিল। মির্জানাগান যিনি বাংলা-আসাম বহু যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তার আত্মজীবনী থেকে দীন-ই-ইলাহি সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়, তবে এক কথা মনে রাখতে হয় যে আকবর গোঁড়া শাসক ছিলেন না। তার ধর্মীয় চরিত্র ছিল সকলের থেকে আলাদা, মৌলবি বা উলেমাদের মতামত নিয়ে তিনি কোনোদিন-ই রাজত্ব চালান নি। আকবর এদেশে প্রকৃতিকে ভালোভাবে বুঝেঝছিলেন। বহু জাতি ধর্মের দেশ এই ভারতবর্ষ। এখানে কোনো একটি বিশেষ ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না, তা সাম্রাজ্যের ভিতকে নষ্ট করবে। সব ধর্মকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। তাই বোধহয় আকবর সুর্যপ্রণাম, সূর্যের নাম জপ, প্রাসাদের ঝরোকরা থেকে সভাসদ এবং প্রজাদের 'দর্শন দেওয়া চালু করেন। গোঁড়া ইসলামীয়দের চোখে আকবরের নীতিগুলো ইসলাম বিরোধী ছিল, তবে আকবর তার নিজস্ব গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে রাজপুত ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।


সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্য

সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্য : খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে উত্তর-ভারতে শুরু হয় সুলতানি শাসন। তারা ছিলেন স্থাপত্যের অনুরাগী। এখন হচ্ছে স্থাপতা বলতে কী বোঝায়? বড়ো বড়ো বাড়িঘর প্রাসাদ মিনার মন্দির-মসজিদে কেল্লা প্রভৃতি নির্মাণকে এক কথায় স্থাপত্য বলে। সবচেয়ে পুরাতন ইসলামীয় স্থাপত্যের খোঁজ পাওয়া গেছে গুজরাটে। ইসলামীয় স্থাপত্য রীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল গম্বুজ ও খিলানের ব্যবহার। ভারতীয় ইসলামীয় শিল্প দুই রীতি একত্রে মিলে সৃষ্টি হয়েছিল ইন্দো ইসলামীয় রীতি। নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যেও অনেক সময় সুলতানরা বিশাল বিশাল স্থাপত্য শিল্প স্থাপন করতেন। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য মসজিদে শিক্ষাপ্রসারের জন্য মাদ্রাসা বিলাসের জন্য প্রাসাদ প্রিয়জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে চমৎকার সব স্মৃতি মন্দির তৈরি করা হত। এগুলিকে আবার সৌধ বা মিনারও বলা হত। এইসব স্থাপত্যের গায়ে দারুন দারুন কারুকার্য থাকত, থাকত শিল্পীর সৃষ্টির নিঁখুত সব কাজ।কুতুবউদ্দিন আইবক এই স্থাপত্য শিল্পের নির্মাণ কাজে হোতা ছিলেন। ইলতুৎমিস নিজের জন্যে একটা চমৎকার স্মৃতিসৌধ বানিয়েছিলেন। ইন্দো-ইসলামীয় স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শন ছিল আলাই দরজাওয়াজা, লাল বেলে পাথরের তৈরি এর গায়ে খোদাই করা ছিল সম্রাট হিসাবে সুলতানের কাজের প্রশংসা—এটা যেন আলাউদ্দিনের দন্তের প্রকাশ। কুতুবমিনার, ইলতুৎমিস-এর সমাধি আলাই দরজা সবকিছু ছিল সুলতানি আমলের স্থাপত্যের নিদর্শন। দিল্লি সুলতান বা শহর পরিকল্পনার ব্যাপারে দারুণ কৃতিত্বের পরিচয় দেয় দৌলতাবাদ থেকে ফিরোজা বাদ সবই নিখুঁত, দিল্লির তুঘলকাবাদে গিয়াসউদ্দিনের সমাধি ও স্থাপত্যের দারুণ নিদর্শন। এখানে গম্বুজ বসানো ঢালু দেওয়াল ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

লোদি সুলতানদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল আটকোণা সমাধি সৌধ। প্রবেশ পথ ছিল বড়ো দরজাওয়ালা বিশাল চত্বর বাগানে ঘেরা সমাধি। মুঘল সম্রাটরাও ছিলেন স্থাপত্য শিল্পের অনুরাগী, তবে তাদের কলাকৌশল কিছুটা আলাদা ছিল। বাবরের আমলে চাহার-বাগ নির্মাণ করা হত, এগুলি আসলে সাজানো বড়ো বাগান। দীন পলাহ শহরটি স্থাপিত হয় হুমায়ুনের আমলে, শেরশাহ তার নিজের স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে ছিলেন সাসারামে। এটি দেখলে মনে হবে যেন তাজমহলের পূর্বসুরি মুঘল আমলে স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ শুরু হয় আকবরের সময় থেকে। তৈরি হয় আগ্রা দুর্গ, সুদৃশ্য দুর্গ তৈরির কাজও শুরু হয় আজমির, লাহোর, কাশ্মীর, এলাহাবাদে। প্রচুর সুদৃশ্য ও দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলা হয়। বুলন্দ-পরওয়াজা বানানো হয় গুজরাট জয়ের স্মৃতিকে ধরে রাখতে। এই সময় শাহজাহান এর মতো না হলেও প্রচুর স্থাপত্য নির্মিত হয়, ফতেপুর, সিক্রি, মসজিদ মহল, দরবার প্রভৃতি। উদারতা ও সৌন্দর্য বোধের প্রকাশ ঘটে ফতেপুরসিক্রি নির্মাণে। আকবর যে সত্যই জাতীয় সম্রাট তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে তার আমলের স্থাপত্য নির্মাণে বিশেষ করে ফতেপুর সিক্রি স্থাপনে। বিভিন্ন প্রদেশের শিল্পকলার সমন্বয় ঘটেছে এখানে। মধ্যযুগে এতখানি উদারতা আগে কখনোও দেখা যায়নি। জাহাঙ্গীরের তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি থেকে জানা যায় জাহাঙ্গীরেরও শখ ছিল বাগান তৈরির আগ্রায়, কাশ্মীরের বাগান তৈরি কথা তিনি লিখেছেন। এই সময় বেশ কয়েকটি পিয়েত্রাদুরা স্থাপত্য হয়েছিল। শ্বেত পাথরের উপর রত্ন বসিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের কাজ করা বলে। পিয়েত্রাপুরা ইরিবাদ-উদ্-দৌলার সমাধি সৌধে পিয়েত্রা কারুকার্য দেখা যায়। তবে মুঘল স্থাপত্যের তথা স্থাপত্য তাজমহল। সম্রাট শাহজাহানের সময়ে তৈরি আশ্চর্য সুন্দর এই স্মৃতিসৌধ। কোনো পাথরের তৈরি মর্মর সমাধি ক্ষেত্রটি মমতাজ মহলের পুরো মৌধটি একই ধরনের পাথর দিয়ে তৈরি সারা গায়ে নানা রত্ন পাথরের অপারদ। এছাড়া লালকেল্লা, জামি মসজিদ মোতি মসজিদ, দেওয়ান আম, দেওয়ানি-ই-খাস প্রভৃতি তো রয়েছেই।ঔরঙ্গজেবের স্থাপত্য শিল্পের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। যুদ্ধ বিদ্রোহ, প্রভৃতি কারণে তার রাজত্বকালে প্রচুর খরচ বেড়ে যায়। তবে বিবি-কা-মকরা তার আমলের বিখ্যাত স্থাপত্য শিল্প। এটি তিনি সুদুর দাক্ষিণাত্যের ঔরঙ্গজেব নির্মাণ করেন।

 বাংলার স্থাপত্য রীতি


 বাংলার স্থাপত্য রীতি : ধীরে ধীরে মুসলিম শাসন বাংলাতেও ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে এখানে যেসব স্থাপত্যশৈলী গড়ে উঠেছে তার নির্মাণ কাঠামোর মূল ভিত্তি ছিল ইসলামীয় রীতি অনুসরণ। স্পাপত্য শিল্পের কারুকাজ চমৎকার। এগুলি নির্মাণের কাঁচামাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলার লৌকিক রীতির ভাপ দেখা যায়।বিভিন্ন নির্মাণ কাজে ইটের ব্যবহার দেখা যায়। তবে বাংলাদেশের স্থাপত্যগুলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বাড়িগুলি এবং বেশিরভাগ মন্দিরগুলির ছাদ ঢালু, বাংলা বৃষ্টিবহুল দেশ, তাই ছাদে জল যাতে না জমে তার জন্যই ছাদ ঢালু করা হয়েছিল। এই বিশেষ নির্মাণ পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছিল "বাংলা"। বাংলা পদ্ধতি সেই সময় খুব বিখ্যাত ছিল। পুরানো বহু মন্দির বা বাড়ির কাঠামো যদি পরপর জুড়ে দেওয়া যেত তবে এর নাম হয়ে যেত জোড় বাংলা।বাংলার মন্দির বানানোর আরো এক রীতি ছিল একে বলা হত ঢাকা। ঢাকার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরণের নামকরণ হত। কোন্‌টি একচালা, দো-চালা চার বা আটচালা হতো। আবার ইসলামীয় রীতি অনুসরণ করে চালার মাথায় কখন মিলান কমন ও বা গম্বুজ বানানো হত। বাংলা স্থাপত্যের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল রত্ন। সাধারণত আয়ত ক্ষেত্রাকার কাঠামোর উপর একাধিক চুড়া বসান হত, কতগুলি চূড়া আছে সেই অনুযায়ী মন্দিরগুলির নামকরণ করা হয়, একটি চূড়া থাকলে সেটি এক রত্নমন্দিরে নামে অভিহিত করা হত। পাঁচটি চুড়া থাকলে তাকে পঞ্চরত্ন মন্দির বলা হত, প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের গায়ে ছিল পোড়া মাটির কাজ। একে এককথায় বলা হত টেরাকোটার কাজ, পোড়ামাটি বা টেরাকোটার কাজ বিখ্যাত ছিল বিঘ্নপুরে। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর ছাড়াও বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে এই কাজ দেখা যায়। বাংলার স্থাপত্য শিল্পের রীতিকে তিন পর্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। ১২০১-১০৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে বলা হত প্রথম পর্যায়। এই সময় বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। প্রথম পর্যায়ে শিল্পরীতির নিদর্শন খুব একটা পাওয়া যায় না। ত্রিবেণীতে জাফর খানের সমাধি, বক্সিরহাটে দুই একটি স্তুপ দেখতে পাওয়া যায়। বাংলা সস্থাপত্য কীর্তির দ্বিতীয় পর্যায় ছিল ১৩৩৯-১৪৪২ খ্রিস্টাব্দ। এই সময়কার নিদর্শন ছিল পান্ডুয়ায় সিকান্দর শাহের তৈরি আদিনা মসজিদ। এছাড়া হুগলির ছোটো পান্ডুয়ার মিনার ও মসজিদ গৌড়ের লেখ আকি সিরাজের মন্দিরের একটি নিদর্শন, ১৪৪২-১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ ছিল স্থাপত্য শিল্পের তৃতীয় পর্যায়, এই পর্যায়ে স্থাপত্য শিল্প সবচেয়ে গৌরবময় স্থান অধিকার করে। এইসময় বাংলার স্থাপত্য রীতির সঙ্গে যুক্ত হয় ইন্দো ইসলামীয় স্থাপত্যরীতি। এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হল একলাথি মন্দির। এটি ছিল পাণ্ডুয়ার সুলতান জালালউদ্দিন মহম্মদ শাহর সমাধি। যদিও এর উচ্চতা খুব বেশি নয় তবে সমাধির কারুকার্য সবার মন কেড়ে নেয়। মন্দিরের দেওয়াল সমাধিস্থল সর্বত্র এই টেরাকোটার কাজ দেখা যায়। একলাখি সমাধিটি ইন্দো-ইসলামীয় স্থাপত্যের উন্নতির অন্যতম উদাহরণ। টেরাকোটার গম্বুজ ও তার অর্ধ গোলাকৃতির জন্য বাংলায় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়া আঁতিপাড়া গম্বুজ ও কোর্টনি মসজিও উল্লেখযোগ্য। ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় ২৬ মিটার উচ্চতার ফিরোজ মিনার, চমৎকার শিল্প সৌন্দর্যের প্রতীক এটি। ইট ও টেরাকোটার কাজ ছাড়াও মিনারটি সাদা ও নীল রং এর চক্ চক্‌ টালি দিয়েও অলংকৃত। এছাড়াও বড়ো সোনার মসজিদ এই যুগের উল্লেখযোগ স্থাপত্য নিদর্শন।


সুলতানি ও মুঘলযুগের শিল্প দরবারি চিত্রকলা

 সুলতানি ও মুঘলযুগের শিল্প দরবারি চিত্রকলা : চিত্রকলা ভারতের সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভারতের বিভিন্ন মন্দির স্মৃতিসৌধ সর্বত্র এর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। তবে সুলতানি ও মোঘল আমলে চিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্র কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল, ধীরে ধীরে চিত্ররীতির মধ্যে বিভিন্ন রীতির সংমিশ্রণ ঘটতে থাকে। এই সংমিশ্রণ শুধু কয়েকটি স্থানে নয় আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। আগেকার যুগে স্থাপত্য শিল্পে স্মৃতিসৌধে চিত্র অঙ্কন করা হত সুলতানি যুগে বই এবং পাণ্ডুলিপিতে ছবি আঁকার চল দেখা যায়। সুন্দর হস্তাক্ষরের সাথে রঙিন চিত্রগুলি মিলিয়ে বইটি সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠত। হিন্দু ও জৈন বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে ছবি আঁকার চল ছিল।উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কল্পসূত্র, কালচক কথা চৌর-পন্থালিকা প্রভৃতি বইগুলিতে সুদৃশ্য ছবি রয়েছে। তাবে পারসিক মহাকাব্য শাহনামা ভারতীয় সংস্করণেও রঙিন চিত্রের সমারোহ দেখা যায়। এই সমস্ত চিত্রে শিল্পীদের বাসস্থান ছিল প্রধানত পশ্চিম ভারতের গুজরাট ইত্যাদি অঞ্চলে। তবে পরে এই শিল্পীরা অনেকে আকবরের কারখানায় যোগ দেন। সুলতানদের চিত্রশিল্পে যে অগ্রগতি দেখা যায়। পরবর্তী মুঘল যুগে তা আরো পরিণত হয়।মুঘল শাসনের প্রবর্তক বাবরের আমলেও ছবি অলংকরণের কাজ হয়েছে। এ ব্যাপারে হুমায়ুন পিছিয়ে ছিলেন না।ইরান ও আফগানিস্তানে যখন ছিলেন সেই সময় দুজন দক্ষ শিল্পীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তাদের কাছে মুগ্ধ হারা হুমায়ুন পরবর্তীকালে তাদের নিয়ে একটি কারখানা খোলেন। সেই কারখানায় সদৃশ্য মলটিসহ বইগুলি দারুণভাবে অলঙ্করণ করা হত। লেখকদের হাতের লেখা দারুণ প্রশংসার দাবি রাখে। বই বাঁধাই, চিত্র অলঙ্করণ এর যে হুমায়ুন শুধু করেছিলেন তা শেষ হয় আকবর-এর সময়ে। দৃশ্যে অলঙ্করণের ঊপহরণে নিদর্শন পাওয়া যায় রজমনাম, নল-দময়ন্তী, মাফের নামা প্রভৃতিতে। এই যুগে ক্যালিগ্রাফির চর্চা ভীষণভাবে হত। ক্যালগ্রাফির শব্দের অর্থ হাতের লেখা চর্চা। বাংলায় একে বলা হত হস্তলিপি বা হস্ত লিপি শিল্প। তখন ছাপাখানার চল আরম্ভ হয়নি। তাই সমস্ত বইগুলি হাতেই লেখা হত। এইগুলিই ছিল শিল্পের নমুনা।

সম্রাট আকবরও অলঙ্করণ শিল্পের ওপর গুরুত্ব দিলেন, তার আমলে নতুন নতুন পুস্তক রচিত হয়েছিলেন। অনেক বইয়ে এর অনুবাদ করা হয়েছিল। তুতিনামা ও মহাভারতের অনুরজমনামা, প্রতিটি বই-এর পৃষ্ঠা সাজানো হত সুন্দর সূক্ষ্ম হাতের লেখা দিয়ে চমৎকার সব ছবি দিয়ে, তবে আকারে ও অয়তনে এইগুলি খুবই ছোটো। আকারে ও আয়তনে ছোটো ছবিগুলি মিনিয়েচার নামে খ্যাত—এটি ইংরেজি শব্দ। বাংলার একে অনুচিত্র বলা হয়ে থাকে। বইগুলি লেখার সময় সোনার রং ও অন্যান্য রং ও ব্যবহার করা হত। রংগুলি এত উজ্জ্বল যে লেখাগুলি জ্বল জ্বল করত। বইগুলি অলঙ্করণের সাথে সাথে প্রতিকৃতি আঁকাও শুরু হয়। তবে আকবরের আমলে এই কাজ শুরু হলেও জাহাঙ্গীরের আমলে তা উন্নতি লাভ করে। মোঘল শিল্পীরিতীতে ইউরোপীয় ছাপ পড়তে শুরু করে। ছিল। ছবি আঁকার বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি বাস্তবতা—প্রকৃতি বাদ-এর ছন্দ এই সময় থেকে একটি নতুন নিয়ম চালু হয় তা হল শিল্পীরা আঁকার শেষে স্বাক্ষর করবে। এরফলে বোঝা সম্ভব হয়। কোনো ছবিটি কোনো শিল্পীর আঁকা,মুঘল যুগে অভিজাত ঘরের মেয়েরাও আঁকার ব্যাপারে খুবই উৎসাহিত ছিলেন। কিন্তু পর্দা প্রথা প্রচলিত থাকায় বাইরের পুরুষ শিখিদের আনা সম্ভব ছিল না, তবে মহিলাদের ছবি আঁকা হত না। তবে নাদিরাবানু, সহিফাবানুর মতো কিছু শিল্পী নিজেরাই ছবি আঁকতেন। শাহজাহান স্থাপত্য শিল্পের পাশাপাশি চিত্র শিল্পের ব্যাপারেও উৎসাহ দিতেন, তার সময় থেকেই ছবিতে নিকট-দূর বোঝানোর পদ্ধতি শুরু হয়। এই সময়ের বিখ্যাত কাজটি হল পাশাহনামার অলঙ্করণ এই বইতে উল্লিখিত চিত্রগুলি ছিল অসাধারণ। তৎকালীন ভারত ইতিহাস রচনার অমূল্য সম্পদ। ঔরঙ্গজেবের আমলে এই সমস্ত শিল্পকার্য বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পীরা দরবার ছেড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যান। অনেক আঞ্চলিক শাসক তাদের আশ্রয় দেন। সুলতানি ও মোগল আমলে চিত্রশিল্পের বিষয়বস্তু হিসাবে অভিঙ্গত ও বাদশাহরা বেশি ছাপ রেখে গেছেন। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ছবিও ফুটে উঠেছে।

 আলিক শিল্প বলয়

আলিক শিল্প বলয় : সুলতান ও মোঘল আমলে বারির শিল্প ছাড়াও বিভিন্ন আঞ্চলিক শিল্প গড়ে উঠেছিল। দেশীয় রীতিতে মুঘল শিল্পি একসময় সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। ছবির বিষয় নানা রঙের ব্যবহার দারুণভাবে করা হয়েছিল। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পৌরাণিক বিষয়গুলি ব্যবহার করা হত বিশেষ করে রাধা-কৃষ্ণের ব্যবহার ছিল বেশি। রাজপুতরা জমিলবগণ ও তাদের রাজসভায় ছবি আঁকাতেন, তবে তাদের আঁকার বিষয় কিন্তু ছিল বাস্তব।


সুলতানি ও মূঘল আমলে নৃত্য গীত

 সংগীত ও নৃত্য : শুধু স্থাপত্য ও ভাস্কর্য চিত্র বলা যায় সুলতানি ও মূঘল আমলে নৃত্য গীতের চর্চা হত। ভারতীয় সঙ্গীত, হাবাতি সংগীত দুটি ধারা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। সুফিরাও তাদের সময় গানকে তাদের আরাধনার অঙ্গ করে তোলেন। কবীর, নানক মীরাবাঈ সকলেই গানকে তাদের ঈশ্বর সাধনার মাধ্যম করে তোলেন। বাংলার শ্রীচৈতন্যদেব ও সঙ্গীতকে আশ্রয় করে ধর্মপ্রচার কতেন। আঞ্চলিক রাজ্যগুলিও সঙ্গীতচর্চার ব্যবহারে উৎসাহি ছিলেন ইব্রাহিম শাহ শরফিকে জৌনপুরের সঙ্গীত শিরোমণি বলা হত। হোসেন শাহ-এর তৈরি নিজস্ব রাগ তৈরি করেছিলেন। একে বলা হয় জৌনপুরী রাগ, মান-কৌতূহল আরেকটি বিখ্যাত সঙ্গীত বিষয়ক পুস্তক। গোয়ালিয়রের রাজা মান সিংহের একজন সঙ্গীত রসিক। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল শাস্ত্রীয় প্রবাদগুলি সংস্কৃত থেকে হিন্দিতে অনুবাদ করা হয়। 

মুঘল সম্রাট আকবর ছিলেন একজন সঙ্গীত রসিক। আবুল ফজলের রচনায় যে ত্রিশজন সঙ্গীতজ্ঞের কথা পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন তানসেন, তার সৃষ্ট বিখ্যাত রাগ ছিল দীপক মেঘমল্লার। কথিত আছে,সঙ্গীতের গ্রুপে প্রদীপ আপনা আপনি জ্বলে উঠত, সঙ্গীতের টানে অকালে বর্ষা নামত। বৈজুবওরা ছিলেন ১৪০০-১৫২৮ সালের মধ্যে একজন বিখ্যাত শিল্পী। তার কণ্ঠস্বরে ছিল অপরিসীম যাদু,শাহজাহানের সময়েও দরবারি সঙ্গীত প্রচলিত ছিল, ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের রথম দশ বৎসর সংগীত প্রচলন ছিল, তারপর বন্ধ হয়ে যায়। তবে ভারতের সঙ্গীত ঐতিহ্য বন্ধ হয়নি। তা আজো সমান ধারায় বয়ে চলেছে।

নৃত্যশিল্প মনিপুরী নৃত্য

 নৃত্যশিল্প মনিপুরী নৃত্য : ধ্রুপদি ভারতের ঐতিহ্য মণ্ডিত নৃত্য শিল্প এর ছটি ভাগ বিশিষ্ট উল্লেখযোগ্য ভারতনাট্যম করাকাই, ওডিশি কুচিপুরি কথক এবং মনিপুরী। ভক্তি আন্দোলনের প্রবল প্রভাব পড়ে মনিপুরি সংস্কৃতিতে, ভক্তিরসের সাথে সঙ্গীত রস মিশে নৃত্য ধারায় যুক্ত নতুন দিক সৃষ্টি হয় সংকীর্তন এবং রাসলীলা,রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে রাসলীলা, ভাগ্যচক্র ছিলেন মনিপুরের মহারাজা একজন সঙ্গীত নৃত্য রসিক। তার আমলে রাসলীলা জীবন ভাবে উন্নত ও জনপ্রিয় হয়, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তিনি নিজেই বিচিত্র পোশাক যাকে বলা হয় কুমিয় পোশাক তা তিনি নিজের হাতেই তৈরি করতেন। সংকীর্তন ছিল একটি বিশেষ ধরনের জনপ্রিয় নৃত্য প্রধানত ছেলে বা পঙ্গু নামে ঢোল বাজিয়ে এই নৃত্য করত।

ভাষা ও সাহিত্য

 ভাষা ও সাহিত্য: আরবি ও ফারসি : 

আরবী ভাষা ভারতীয় ভাষা নয়। আরবদেশে ইসলামের জন্ম হলেও তার প্রচার হয় আরবি ভাষাতেই। এই ভাষার প্রয়োজন ছিল ভারতের শিক্ষিত মুসলমানদের কাছে। বেশ কিছু সরকারি পুস্তকও এই ভাষায় রচিত হয়, এর মধ্যে তখনকার আইন ব্যবস্থার বিশেষ দলিল। এটি ঔরঙ্গজেবের সময়ে রচিত হয়েছিলো, মধ্যযুগে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। তুর্কিরা যখন ভারতে আসে তখন থেকে ফারসি ভাষার প্রচলন ঘটে। কুতবউদ্দিন আইবক এবং ইলতুৎমিস এই ভাষাকে প্রাধান্য দেন, তবে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে খলছি যুগের অবদান কম নয়। এই যুগে লাহোর শহর হয়ে ওঠে ফারসি ভাষাচর্চার অন্যতম কেন্দ্র। ফারসি দার্শনিক ও সাহিত্যিক ছিলেন আমীর খসরু। তিনি ভারতের তোতাপাখি নামে পরিচিত ছিলেন। ফারসি ভাষায় তার রচনা আজো সকলের মন কাড়ে। ১২৫২ সালে উত্তর প্রদেশের বদাউনের কাছে পাটিয়ালিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মনে করতেন তিনি ভারতীয় তুর্কী শাসক বা তাদের মানসিকতা বদলে এদেশ থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আক্রমণকারীদের বদলে তারাই সংগঠনকারী হয়ে ওঠে, খসবুর কাব্য সাহিত্য নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন এবং আবিষ্কার করেন এক নতুন রচনাশৈলী, যার নাম সবক-ই-হিন্দু। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মুসলিম ঐতিহাসিকদের পছন্দের ভাষা ছিল ফারসী মিনহাজ-উস-সিরাজ, ইসামি জিয়াউদ্দিন বারনি প্রমুখ ইতিহাসিক ইতিহাস রচনার জন্যে ফারসি ভাষা পছন্দ করতেন। এই যুগে মূল সংস্কৃত থেকে অনেক গল্প ফারসিতে অনুবাদ করেন। জিয়া নকশাবি ছিলেন এই ধারার লেখ। তিনি ভাষায় রচিত গল্পমালাকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। এই গ্রন্থটির নাম দেন তুতিনামা। কাশ্মীরের মুলতান জৈন—উলআবেতিনের উৎসাহে কলহন রাজতরঙ্গীনী এবং মহাভারত ফারসিতে অনুবাদ করা হয়। তুঘলকের আমলেও এই অনুবাদের ধারা চলতে থাকে। দক্ষিণ ভারতের বাহমান সুলতানেরা ফারসি ভাষাচর্চায় আগ্রহ দেখান। বাহমনি রাজধানি গুলবর্গা এবং বিদরা ছিল ফারসি ভাষা এই সাহিত্যচচর্যার মূখ্য কেন্দ্র। ফারসি ভাষার কার্যকরিতা আরো বাড়ে মোগল আমলে। তুজুক-ই বাবরী রচিত হয়েছিল তুর্কী ভারতে। হুমায়ুন এই ভাষাটিকে ভীষনভাবে পছন্দ করতেন। কাসিম খান মৌজি তিনি হুমায়ুন ও আকবরের সভাকবি ছিলেন, এই ভাষার টানে পারস্যের বহু কবি সাহিত্যিক প্রদেশের দরবারে ভিড় করেন। এর ফলে ভারতীয় সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এদেশে পথপ্রদর্শক ছিলেন ফৈজী, উরফি নাজিবি বেদিলে প্রমুখ। আকবরের সময় ফারসি ভাষার দ্রুত বিকাশ ঘটে। তার আমলের রচনাগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে (১) : ইতিহাস রচনা (২) অনুবাদ সাহিত্য। (৩) কবিতা। এই সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য রচনা ছিল আবুল ফজলের আকবারনামা এবং আইন-ই-আকবরী। বাউনের মুক্তাখাব উস ওয়ারিখ এবং নিজামউদ্দিন আহমেদের তবকাত-ই-আকবরি ইত্যাদি। আকবরের মতো ফারসি ভাষাকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর, এই সময়ের বিখ্যাত ছিলেন তালিব আমুলি। শাহাজাহানের সময়ও ফারসি ভাষার উন্নতি ঘটতে থাকে, এযুগের বিখ্যাত দরবারি ঐতিহাসিক ছিলেন আব্দুল হামিদ লাহোরি। তিনি ফারসি ভাষায় ইতিহাস রচনা শুরু করেছিলেন। এই ভাষার চর্চা একেবারে কমে আসে, ঔরঙ্গজেবের কন্যা জৈব-উন-নিসা এই ভাষা পছন্দ করতেন, কবিতা লিখতেন। সম্রাট নিজেও এই ভাষা জানতেন। তবে একথা ঠিক যে শুধু মুসলমানরা নয় হিন্দুরাও এই ভাষা চর্চা করত। এর প্রমাণ ঈশ্বর দাস নগর চন্দ্র, ভানু ব্রাহ্মণ বা জীমসেন বুরহানপুরির মতো লেখকদের রচনা।

রজতনামা


 আকবর ফারসি ভাষা নিয়ে খুবই উৎসাহ ছিলেন, তিনি নিজে কয়েক অনুবাদক নিয়োগ করে মহাভারতের বিভিন্ন অংশ অনুবাদ করে তার নাম দেন রজতনামা। মহাভারতের ন্যায় রামায়ণও বারসি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল। এই কাজ করেছিলেন বাউনি। রামায়ণের পাশাপাশি বেস-এর ও অনুবাদন হয়েছিল। বেদ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন—ইব্রাহিম সিন্ধি, রাজা টোডরমল ভাগবৎ পুরাণ ফারসি অনুবাদ করেন। এমনকি বেশ কিছু গ্রিক সাহিত্যও ফারসিতে অনুদিত হয়েছিল।

 বাংলা সাহিত্য : প্রাচীন যুগে ভাষা কেমন ছিল, সুলতানি যুগে তার চিত্র কেমন ছিল তা আজ ঠিকমতো বলা সম্ভব নয়, তবে সেই সময় কার কিছু কিছু পুঁথি পাওয়া গেছে। এই যুগের উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন--বড়ু চণ্ডীদাস । 

বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর ভাষা থেকে সুলতানি আমলে বংলা ভাষা কেমন ছিল সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করাও সম্ভব। বাংলায় ইলিয়াস নাহি শাসন শুরু হলে সেই সময় থেকে বাংলা ভাষায় লেখালেখি শুরু হয়। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে এসময় বাংলা ভাষা ছিল নানারকম। তখন সাহিত্যে দেবদেবির মহিমা প্রচার ছিল সবচেয়ে বড়ো উদ্দেশ্য। সাধারণ মানুষের কথা বড়ো একটা থাকত না। এই সময় এক ধরনের রচনা খুব প্রচলিত ছিল তা হল পাঁচালি, পাঁচালি হল অনেক রকমের লেখালেখি একত্রে থাকা। 

রামায়ণ মহাভারত বা দেবদেবীর সবারই পাঁচালি গাওয়ার রেওয়াজ ছিল খুব বেশি, এইগুলি সুর করে চণ্ডিমণ্ডব বা মন্দিরে গাওয়া হত। ধীরে ধীরে যুগের পরিবর্তন ঘটেছে। তার সাথে সাহিত্যের পরিবর্তন হয়েছে। শুধুমাত্র ধর্মীয় রুনা ছেড়ে সাহিত্যে সাধারণ মানুষের সুখ-দুখঃ খের কথা স্থান পেতে সুরু করে, ভক্তি ধর্মের প্রভাবে বাংলায় জীবনী সাহিত্য লেখা শুধু হয়। শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে যেমন কাব্য লেখা চল ছিল তেমনি রাধা-কৃয়কে নিয়ে পদ রচনাও করা হত একে বলা হত পদাবলি সাহিত্য। এই পদাবলি সাহিত্য খুবই জনপ্রিয় ছিল। এ যুগেও তার জনপ্রিয়তা কিছু কম নয়। রামাইও মহাভারত এ যুগের মতো সে যুগেও ভীষন জনপ্রিয় ছিল, তাই এগুলির অনুবাদ হয়েছিল কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ, কাশীরাম বস-এর মহাভারত ভগবতের অনেকটাই বাংলায় অনুবাদ হয়েছিল। এই অনুবাদটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়'—এই অনুবাদ করেছিলেন বিখ্যাত কবি মালাধর বসু। বাংলা সাহিত্যের আর একটি জনপ্রিয় ধারা হল মঙ্গলকাব্য, বাংলা দেশ বৈচিত্রপূর্ণ দেশ। কাব্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই বৈচিত্র বর্তমান। রামায়ণ, মহাভারত ছাড়া সাহিত্যের অপর ধারাটি ছিল মঙ্গল কাব্য। চন্ডী মনসা ধর্মমঙ্গল এই সমস্ত দেবদেবীর নিয়ত পূজার প্রচলন ছিল। দেবদেবীর নামে গান গেয়ে তাদের কথা প্রচার করা হত। প্রত্যেকটা গানের মধ্যেই লুকিয়ে থাকত এক একটি গল্প। এই গল্পগুলিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে নানা গল্প। মঙ্গল যার অর্থ হল ভালো। যেসব দেবদেবী পূজা ভক্তরা মনে করবে কল্যান অর্থাৎ ভালো হবে। দেবি চণ্ডিকে নিয়ে যে গল্প প্রচলিত ছিল তার নাম হল 'চণ্ডিমঙ্গল', আবার মনসাদেবীকে রচিত গল্পকে বলা হয় মনসা মঙ্গল। তেমনি ধর্মঠাকুর-কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ধর্মমঙ্গল। গান বা গল্পের মধ্যে এই সমস্ত ঠাকুরের মহিমাই প্রচার করা হয়েছে। তাদের পূজা মর্তবামে প্রচলন করার চেষ্টা হয়েছে। তবে সমস্ত দেবদেশী প্রথম দিকে নীচু তলার মানুষদের পুজোই পেতেন, এই ধরনের গল্পগুলিতে সাধারণ মানুষের দুঃখ সুংখ হাসি কান্না তাদের জীবনে যাত্রার ছবি পাওয়া যায়। এই যুগে শিব পূজা জনপ্রিয় ছিল, শিব ঠাকুরকে নিয়ে যেসব কাহিনি প্রচলিত রয়েছে তাকে শিবায়ন বলে। শিব এবং দুর্গা এখানে একেবারে গরিব চরিত্র। গরীবদের জীবনের বারোমাস্যা এখানে বর্ণিত হয়েছে। গরীব শিব এখানে চাষি, তিনি চাষবাস করেন। শিব ও দূর্গা এই চরিত্রের মধ্যে যেন চরিত্র কৃষকদের জীবনযাত্রার ছবি উঠে এসেছে। এই সমাজে যে নাথ নামে ধর্ম সম্প্রদায় ছিল তাদের প্রধান দেবতা শিব। এই নাথদের কেন্দ্র করেও নানা সাহিত্য রচিত হয়েছে। তাদের জীবনের দুঃখের কথা ধর্মকর্ম আচার-আচরণ নিয়ে যে সাহিত্য গড়ে ওঠে তাকে নাথ সাহিত্য এই সাহিত্যগুলিতে শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাস জীবনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জীবনি সাহিত্য রচনার কাজও এই সময় থেকে শুরু করেন। যে-কোনো অনুষ্ঠানের শুরুতে এই পদ পাওয়া হতো। এ গানকে গৌরচন্দ্রিকা বলা হত চৈতন্যের জীবনী নিয়ে রচিত সাহিত্যকে চৈতন্যজীবনী কাব্য বলা হত। আরবি এবং বাংলা ভাষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কাব্য রচনা পর্ব শুরু হয়। এই পর্বে অন্যতম কবি ছিলেন সৈয়দ আলাওল, দৌলত কাজী, আলাওলের বিখ্যাত কাব্য ছিল ‘পদ্মাবতী'। এই কাব্য থেকে আলাউদ্দিন খলব্ধির চিতোর অভিযানের কথা জানতে পরি।


মন্তব্যসমূহ